তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের বক্তৃতার সিডি জোগাড় করতে জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দিল রাজ্য নির্বাচন কমিশন। বৃহস্পতিবার কমিশনের এক কর্তা বলেন, “সিডি চাওয়া হয়েছে। ওই বক্তৃতা নিয়ে একটি রিপোর্টও চাওয়া হয়েছে।” কমিশন সূত্রের খবর, অনুব্রতবাবুর বিরুদ্ধে এফআইআর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জেলাশাসকের কাছে সেই মতো নির্দেশও পাঠিয়েছে কমিশন।
বুধবার বীরভূমের পাড়ুই থানার কসবা পঞ্চায়েত এলাকায় একটি জনসভায় অনুব্রত বলেন, “যদি কোনও প্রশাসন ভাবে, নির্দলকে সমর্থন করবে, সেই প্রশাসনের পুলিশের উপরে বোমা মারুন। আমি বলছি, বোমা মারতে।” স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্রের খবর, কসবা পঞ্চায়েতে লড়াই মূলত তৃণমূলের সঙ্গে দলেরই টিকিট না পাওয়া বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর। টিকিট না পেয়ে তৃণমূলের একটি অংশ পঞ্চায়েত ভোটে নির্দল হিসেবে দাঁড়িয়েছে। প্রশাসনের সঙ্গে নির্দলদের সম্পর্ক বোঝাতে দলেরই বিক্ষুব্ধ অংশকে বুঝিয়েছেন অনুব্রতবাবু। তবে প্রকাশ্য জনসভায় দলের জেলা সভাপতি পুলিশের উপরে বোমা মারতে বলায় স্বাভাবিক ভাবেই প্রশাসনের অন্দরে চাপান-উতোর শুরু হয়েছে। দলের তরফে জেলা পর্যবেক্ষক রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী মলয় ঘটক অবশ্য অনুব্রতবাবুকে সতর্ক করেছেন বলে দাবি করেছেন।
তাঁর বক্তব্য নিয়ে হইচই শুরু হওয়ার পরে বৃহস্পতিবার বিষয়টি নিয়ে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন অনুব্রতবাবু। এ দিন সকালে বোলপুরে নিজের বাড়িতে তিনি বলেন, “আমি ওটা বলতে চাইনি। কসবা অঞ্চলে দীর্ঘ দিন ধরেই কিছু সমাজবিরোধী আমাদের কর্মী-সমর্থকদের বাড়ি পুড়িয়েছে। নির্বাচনী প্রচার সেরে ফেরার পথে দিন দু’য়েক আগে একাধিক কর্মী-সমর্থককে মারধর করেছে। এমনকী এক জনকে বর্ধমান থেকে এসএসকেএম পর্যন্ত স্থানান্তর করতে হয়েছে। ওর অবস্থা এখন সঙ্কটজনক। গত ৩৪ বছর ধরে বামফ্রন্ট এলাকার উন্নয়ন করেনি। কসবা এলাকায় রাস্তাঘাটের অবস্থা শোচনীয়। কোনও ঘটনা ঘটলে পুলিশের গাড়ি সহজে মুভ করতে পারে না। অনেক সময়ে দূর থেকে পুলিশের গাড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারে না। কিন্তু গণ্ডগোল হয়। পুলিশের গাড়িও আক্রান্ত হয়। আমি এই বিষয়টাই বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ‘স্লিপ অফ টাং’ হয়ে ওমন কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে।” জেলা রাজনীতিতে অনুব্রত-বিরোধী শিবিরে থাকা বীরভূমের তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায় আবার বলেন, “আমি বিষয়টিকে সমর্থন করি না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবই শুনছেন। সবই দেখছেন। তিনি নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেবেন।”
অনুব্রতবাবু নিজে যতই সুর নরম করুন বা শতাব্দী যা-ই বলুন, বিরোধীরা বিষয়টিকে অস্ত্র করতে ছাড়েনি। বুধবারই এ নিয়ে সরব হয়েছিল সিপিএম-কংগ্রেস। এ দিন বীরভূমের রামপুরহাটে এক নির্বাচনী জনসভায় বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “অনুব্রত মণ্ডলের ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরাসরি মদত আছে। তা না হলে তিনি (অনুব্রত) ওই সব কথা বলতে পারতেন না।” তাঁর দাবি, “প্ররোচনামূলক বক্তব্য দেওয়ার জন্য ওঁকে (অনুব্রত) অবিলম্বে গ্রেফতার করা উচিত। তাঁর ওই বক্তব্য রাখার পরেপরেই যে ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে, তার জন্য এফআইআর-এ এক নম্বরে ওঁর (অনুব্রত) নাম থাকা উচিত।”
পরে বিরোধী দলনেতা বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী নিজেই হুমকি দিয়েছেন। বদলা নেব, এই সব বলেছেন। উনি নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন কাউকেই মানছেন না। রাজ্যে বিরোধীদের নিরাপত্তা নেই। এখন মুখ্যমন্ত্রীর নিজের দলের একজন জেলা সভাপতি পুলিশকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার কথা বলছেন! এ বার দেখছি পুলিশেরও নিরাপত্তা নেই!” সেই সঙ্গেই তাঁর কটাক্ষ, “এক জনের কত বার মুখ ফস্কায়! সরকারি আইন, প্রশাসনের হাত থেকে তিনি বারবার কী করে ফস্কাচ্ছেন?” অনুব্রতবাবুকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে এ দিন শমীক ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে বিজেপির একটি প্রতিনিধি দল কমিশনের অফিসে যায়।
কমিশন সূত্রে খবর, বুধবার রাতে অনুব্রতবাবুর বক্তৃতা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হতেই নড়েচড়ে বসেন কমিশন কর্তারা। সেই মতো নির্দেশ যায় বীরভূম জেলা প্রশাসনের কর্তাদের কাছে। এ দিন দুপুরে কমিশনের এক অফিসারকে বীরভূমে পাঠানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে তা বদল করা হয়। কমিশনের এক কর্তার বক্তব্য, “ওই অফিসার পঞ্চায়েত ভোটে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। আজ, শুক্রবার উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং হাওড়ায় ভোট রয়েছে। তিনি বীরভূম চলে গেলে অসুবিধা হত।” এই কারণেই জেলাশাসককে অনুব্রতবাবুর বিরুদ্ধে এফআইআর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কমিশন সূত্রের ব্যাখ্যা, জেলাশাসক নিজে অথবা তাঁর কোনও অধঃস্তন কর্মচারীকে দিয়ে মামলা দায়ের করাতে পারেন। প্রয়োজন হলে কোনও থানার ওসি-ও মামলা দায়ের করাতে পারেন।
কমিশন অনুব্রতবাবুর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করালেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন রয়েইছে। এর আগেও রামপুরহাটে এক দলীয় কর্মিসভায় অনুব্রতবাবু বলেছিলেন, “কংগ্রেস-সিপিএম আমাদের শত্রু। কাউকে মনোনয়ন ফাইল করতে দেবেন না। দরকার হলে আমাকে ডাকবেন। আমি আপনাদের পাশে থাকব।” তা নিয়ে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানান বিরোধীরা। কমিশন সূত্রের দাবি, দেরিতে হলেও ওই ঘটনায় এফআইআর দায়ের হয়েছে। কিন্তু এখনও সে ব্যাপারে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেই খবর। আজ, শুক্রবার বীরভূমের রামপুরহাট ও দুবরাজপুরে নির্বাচনী সমাবেশ রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর। সেখানে তাঁর বক্তৃতায় অনুব্রতর প্রসঙ্গ ওঠে কি না, সেটাই দেখার।
|