|
|
|
|
নতুন শুরুর অপেক্ষায় বার-নর্তকীরা |
নীচে নামতে হল সাত বছরে, এটাই আফসোস |
পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় • কলকাতা |
পাওলো কোয়েলহো-র ‘ইলেভেন মিনিটস’ উপন্যাসের নায়িকা মারিয়ার সঙ্গে একটা জায়গায় রঞ্জিতার (নাম পরিবর্তিত) খুব মিল। দু’জনেই গ্রাম থেকে শহরে এসে ডান্স বারে উপার্জনের পথ খুঁজে নিয়েছিলেন। পরিস্থিতির ঘূর্ণিতে সেই চাকরি চলে যায় এবং জীবনধারণের জন্য দু’জনকেই যৌনপেশায় নামতে হয়।
মহারাষ্ট্রে ডান্সবারের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার খবরে বাঙালি মেয়ে রঞ্জিতার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল “বড্ড দেরি হয়ে গেল। ভেবেছিলাম, পরিবারটাকে বাঁচাতে নেচেগেয়ে রোজগার করলেও কখনও শরীর বেচব না। পারিনি। এখন কোর্ট আমাদের পক্ষে রায় দিলেও আমি অনেক নীচে নেমে গিয়েছি, খারাপ হয়ে গিয়েছি।”
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আলতামাস কবীর ও বিচারপতি এসএস নিজ্জরের রায়ে জয়ের প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কাটিয়ে ওঠার পর ডান্সবারের মেয়েরা এবং সমাজকর্মীদের একটা বড় অংশের মধ্যে এই আফসোসটাই পাক খাচ্ছে। সাত বছর ধরে প্রায় ১৩০০ ডান্সবার বন্ধ থাকার অভিঘাতটা ইতিমধ্যে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে অসংখ্য মহিলাকে, যার একটা বড় অংশই বাঙালি। অভাবের তাড়নায় কেউ পাচার হয়ে গিয়েছেন পশ্চিম এশিয়ায়, কেউ আত্মঘাতী হয়েছেন আর বাকিরা বেশির ভাগই বাধ্য হয়েছেন নামমাত্র টাকায় যৌনপেশা বেছে নিতে।
মহারাষ্ট্রে বার ডান্সারদের সবচেয়ে বড় সংগঠন ‘ভারতীয় বার গার্লস ইউনিয়ন’-এর দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৭৫ হাজার নর্তকীর মধ্যে ১৩-১৫ হাজার ছিলেন বাঙালি। অনেকে বাংলাদেশের। আর পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুর্শিদাবাদ-মালদহ-নদিয়া-উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার মেয়ে সবচেয়ে বেশি। সংগঠনের সভাপতি বর্ষা কালে টেলিফোনে বলছিলেন, “এত বেশি বাঙালি মেয়ে ছিলেন যে, ওঁদের জন্য বার-এর বাইরে বা রাতের ট্রেনে রসগোল্লাওয়ালা, মাছভাজাওয়ালারা ভিড় জমাত। অন্যরাও ওঁদের দৌলতে ভাঙা বাংলা শিখে গিয়েছিল।” |
|
বরিভেলির ‘উৎসব’ ডান্সবার ১৭ বছর ধরে রমরমে ব্যবসা করত। মালিক বিকাশ সাবন্ত জানালেন, বার-এ ২৫ জন নর্তকীর মধ্যে ১২ জনই ছিলেন বাঙালি। খদ্দেরদের টিপ্স নিয়ে এঁদের অনেকেরই মাসিক রোজগার ছিল ৩০-৪০ হাজার টাকা। ডান্সবার বন্ধ হয়ে যেতে এঁরা রাতারাতি জলে পড়েন। বিকাশের কথায়, “রাস্তায় আড়ালে-আবডালে পুলিশ বাঁচিয়ে এরা যৌনপেশা চালাতে বাধ্য হন। যেহেতু বার বন্ধ, খদ্দেরদের সঙ্গে দর কষাকষির সুযোগ ছিল না। পুরনো অনেক মেয়ে দেখা করতে এসে কেঁদে ফেলেন। অসুরক্ষিত যৌনসম্পর্কে যেতে বাধ্য হয়ে তাঁরা কেউ কেউ এইচআইভি আক্রান্ত হয়েছেন।”
বর্ষা দাবি করেন, রুজি বন্ধ হওয়ার পর তাঁর পরিচিত চার জন বাঙালি নর্তকী আত্মহত্যা করেছিলেন। বর্ষা নিজে সাহায্যের জন্য ছুটে এসেছিলেন কলকাতায়। দেখা করেছিলেন একাধিক মন্ত্রী আর বিশিষ্ট জনের সঙ্গে। সহায়তা মেলেনি। পাচারকারীর খপ্পরে পড়ে অনেক মেয়ে দুবাই, আবুধাবির যৌনপল্লিতে চলে যান। যৌন অত্যাচারে অসুস্থ, সর্বস্বান্ত হয়ে ফিরেছেন। গীতা, সন্ধ্যা, শবনম, পিঙ্কি, অঞ্চিতা, জুলি এমন অসংখ্য মেয়ে গত সাত বছর কার্যত নরকদর্শন করেছেন।
আদালতের রায় শোনার পর কারও বাড়ি বহুদিন পরে মাংস রান্না হয়েছে, কেউ পাড়ায় মিষ্টি বিলিয়েছেন। বরিভেলির ‘ইলোরা’ বার-এ ডান্সগার্ল ছিলেন বাঙালি মেয়ে নিকিতা। জানালেন, রুজির জন্য বিভিন্ন লজ, হোটেল আর ফার্ম হাউসে ‘প্রাইভেট’ নাচের আসরে যেতে হয়েছে মেয়েদের। সেখানে তাঁদের কোনও নিরাপত্তা নেই। মুম্বইয়ের কংগ্রেস হাউস, বানারস কি চাল-এর মতো জায়গায় মুজরার আসরে যেতে হয়েছে অনেক কম টাকায়। “আমার বাঙালি বন্ধুদের অনেকেরই ছেলেমেয়ে হয়ে গিয়েছিল। স্বামী দেখত না। অভাবের চোটে এঁদের অনেককে যৌনকর্মী হতে হয়েছে।”
বর্ষাও বলছিলেন, মহারাষ্ট্রে ইদানীং শুধু অর্কেস্ট্রা বার আর লেডিজ বার চালু ছিল। সেখানে মাস গেলে মেরেকেটে ৩-৪ হাজার টাকা মাইনে। মুম্বইয়ে একটা চাল ভাড়াতেই ৩ হাজার টাকা চলে যায়। ফলে অল্পশিক্ষিত এই মেয়েদের যৌনব্যবসা ছাড়া গতি থাকত না। বাংলাদেশ থেকে একসঙ্গে অনেক মেয়েকে আনত দালালরা। জনা পনেরো মেয়েকে একটা খুপরি ঘর ভাড়া করে রাখা হত। তাঁদের অর্কেস্ট্রা বার বা লেডিজ বারে পাঠানো হত। টাকা যা আসত, তার বেশির ভাগ দালালরাই নিয়ে নিত।
সেই সব দিন পেরিয়ে অবশেষে জয় এসেছে। এই সাত বছর মুম্বইয়ের ৩২৫টি ডান্সবার লাইসেন্স সারেন্ডার না করে সাসপেনশনে রেখেছিল। এখন মাসখানেকের মধ্যে প্রথমে সেগুলিই চালু হওয়ার কথা। বর্ষারা বলছেন, “আমহালা ন্যায় মিলালা (আমরা ন্যায় পেয়েছি)। দেরিতে হলেও হল তো!” সাত বছরের অনভ্যাস, আত্মবিশ্বাসে টান পড়ছে। তবু একটু-একটু করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন গীতা, সন্ধ্যারাও বার-এ চাঁদনি ফিরবে তো?
|
পুরনো খবর: মুম্বইয়ে ডান্স বার চালুর নির্দেশ |
|
|
|
|
|