অবরোধ এ বার যশোহর রোডে
পুলিশের জমাট ক্ষোভই কি ফুটে বেরোচ্ছে ভোটে
প্রথমে বাঁকুড়া। তার পরে কলকাতার ডায়মন্ড হারবার রোড। এ বার মধ্যমগ্রাম। পঞ্চায়েত ভোটের ডিউটি নিয়ে পুলিশের বিক্ষোভ চলছেই। প্রশ্ন উঠেছে, শৃঙ্খলারক্ষা যাদের কাজ, সেই শৃঙ্খলাবদ্ধ পুলিশের এমন অসহিষ্ণুতা কেন? প্রশ্ন উঠেছে, লোকবলের অভাব-সহ নানা কারণে পুলিশে পুঞ্জীভূত ক্ষোভেরই কি প্রকাশ ঘটছে ভোট-ডিউটিকে কেন্দ্র করে?
পুলিশি বিক্ষোভের জেরেই বুধবার সকালে ঘণ্টাখানেকের জন্য অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে ব্যস্ত যশোহর রোড। বিক্ষোভকারী হোমগার্ডদের অভিযোগ, উত্তর ২৪ পরগনায় ভোটের ডিউটির জন্য মধ্যমগ্রামের বিবেকানন্দ কলেজের লাগোয়া যে-বাড়িতে তাঁদের রাখা হয়েছে, সেখানে খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্ত নেই।
এমনকী পানীয় জলের ব্যবস্থাও করেনি জেলা প্রশাসন। মঙ্গলবার রাতে ওই বাড়িতে ওঠার পরে বারবার জানিয়েও সুরাহা না-হওয়ায় বাধ্য হয়েই তাঁরা পথ অবরোধ শুরু করেন বলে জানান বিক্ষোভকারীরা। জাকির হোসেন নামে এক হোমগার্ড বলেন, “আমরা পুরুলিয়া, বাঁকুড়ায় ডিউটি করে এসেছি। কিন্তু সেখানেও এত অব্যবস্থা ছিল না। এখানে খাবার জল তো মিলছেই না। শৌচকর্মের জলও নিজেদের জোগাড় করতে হচ্ছে।”
মধ্যমগ্রামে হোমগার্ডদের বিক্ষোভ। ছবি: সুদীপ ঘোষ।
কয়েকশো পুলিশকর্মীকে পথে নেমে বিক্ষোভে সামিল হতে দেখে প্রমাদ গোনে জেলা প্রশাসন। সকালের ব্যস্ত সময়ে অবরোধের ফলে ৩৪ এবং ৩৫ নম্বর জাতীয় সড়ক তো বটেই, বসিরহাট, বাদু, সোদপুরের রাস্তাতেও যান চলাচল বিপর্যস্ত হয়ে যায়। দুপুরের দিকে ওই রাস্তা দিয়েই মুখ্যমন্ত্রীর নদিয়া যাওয়ার কথা ছিল। প্রশাসনের কর্তারা তাই চটজলদি বিক্ষোভস্থলে পৌঁছে যান। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় মধ্যমগ্রাম গার্লস হাইস্কুলে। ভোট শেষ হওয়া পর্যন্ত তাঁরা সেখানেই থাকবেন।
এ দিনের ঘটনাকে অবশ্য গুরুত্ব দিতে চাননি জেলাশাসক সঞ্জয় বনশল। তাঁর দাবি, “ওঁদের তেমন কোনও অসুবিধা হয়নি।” আর পুলিশ সুপার সুগত সেন বলেন, “লোডশেডিংয়ের জন্য সাময়িক ভাবে জলের একটু অসুবিধা হয়েছিল। পরে ঠিক হয়ে গিয়েছে।”
নিচু তলার পুলিশের একাংশের অভিযোগ, ভোট-ডিউটিতে কোথাও কোথাও তাঁদের প্রতি অমানবিক ব্যবহার করা হচ্ছে। হাওড়ায় ডিউটি করতে যাওয়া কলকাতা পুলিশের একাধিক কর্মী জানান, উৎপল নস্কর নামে তাঁদের এক সহকর্মী বুধবার বিকেলে আন্দুলের প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজে অসুস্থ হয়ে পড়েন। মিনি ট্রাকে চাপিয়ে তাঁকে সাঁকরাইল
থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে
ওই পুলিশকর্মীকে এক ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয় ট্রাকেই। তিনি হাঁপাতে থাকেন। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দেন। জেলা পুলিশ অবশ্য বলেছে, গাড়ির ব্যবস্থা করতে দেরি হওয়াতেই এই বিপত্তি। পরে উৎপলবাবুকে কলকাতা পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
সোমবার কলকাতা পুলিশের অফিসার ও কনস্টেবলদের একটি বড় অংশ বাঁকুড়ার পুলিশলাইনে পৌঁছে মাওবাদী প্রভাবিত এলাকায় যাবেন না বলে বেঁকে বসেন। ওই পুলিশকর্মীদের বক্তব্য ছিল, মান্ধাতার আমলের থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল হাতে দিয়ে তাঁদের বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। লালবাজার থেকে বলা হয়, কলকাতা থেকে যাওয়া পুলিশকর্মীদের অনেককেই বাঁকুড়া জেলা থেকে অস্ত্র দেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যে বেশ কয়েকটি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল অকেজো ছিল। তাতেই ওঁরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
আর ডায়মন্ড হারবার রোড অবরোধে সামিল পুলিশকর্মীদের বক্তব্য ছিল, পূর্ব মেদিনীপুর থেকে দ্বিতীয় দফার ভোটের ডিউটি সেরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুরে যাওয়ার পথে উলুবেড়িয়া ও ডোমজুড়ে তাঁদের দু’টি বাস দুর্ঘটনায় পড়ে। তাতে কয়েক জন আহত হওয়ার পরেও তাঁদের ফের ভোটের ডিউটিতে যাওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করছিলেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। প্রতিবাদ জানাতে বিষ্ণুপুরে না-গিয়ে তাঁরা সোজা চলে যান আলিপুরের বডিগার্ড লাইনে। তার পরেই অবরোধ করেন ডায়মন্ড হারবার রোড।
কিন্তু শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনী একের পর এক অবরোধে নামছে কেন?
পুলিশকর্তাদের একাংশ জানান, চাকরিজীবনে তাঁরাও নিচু তলার কর্মীদের এ ভাবে কথায় কথায় অসহিষ্ণু হতে দেখেননি। দিনের পর দিন হাড়ভাঙা খাটুনির পরেও পুলিশকর্মীরা সংযতই থেকেছেন, যা শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনীর দস্তুর। তাঁদের বক্তব্য, রাজ্য পুলিশে বহু পদ দীর্ঘদিন খালি পড়ে আছে। অথচ কাজ বেড়েই চলেছে। পরিস্থিতি এমনই যে, এক জনকে দু’তিন জনের কাজ করতে হচ্ছে। তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাই হোক কিংবা থানার রোজকার কাজ। কিছুটা সেই কারণেই পুলিশের একাংশের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধছে বলে ওই পুলিশকর্তাদের অভিমত।
পুলিশকর্তাদের অন্য একটি অংশ অবশ্য এই যুক্তি মানতে চাননি। তাঁদের বক্তব্য, দিনরাত পরিশ্রম করতে হবে জেনেই লোকে পুলিশের চাকরিতে যোগ দেন। যাঁরা তা পারেন না, তাঁরা অন্য চাকরিতে চলে যান। কিন্তু বাহিনীতে থেকে বিক্ষোভে পথে নামার ঘটনা ইদানীং বাড়ছে। কেন?
ওই পুলিশকর্তারা বলছেন, সম্প্রতি রাজ্যের নানা প্রান্তে আইনরক্ষকদের সামনেই দুষ্কৃতী-তাণ্ডব চলেছে। তা থামাতে গিয়ে পুলিশ আক্রান্ত হয়েছে। তার পরেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে পুলিশকেই নিয়ন্ত্রণ করা হয় বলে অভিযোগ রাজ্য প্রশাসনের একাংশের। ওই প্রশাসনিক কর্তাদের বক্তব্য, গত রবিবার কামারহাটিতে গোলমাল থামাতে গেলে পুলিশকে মাটিতে ফেলে মারা হয়। পুলিশ পরে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগ এনে ১৫ জনকে গ্রেফতারও করে। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যে রাজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী থানায় গিয়ে ধৃতদের ছাড়িয়ে নিয়ে যান। রাজ্য প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য, এটাও পুলিশের সহিষ্ণুতা কমে যাওয়ার একটা বড় কারণ।
একাধিক পুলিশকর্তা বলছেন, বীরভূমের লোবায় বিক্ষোভকারীদের হাতে পুলিশ আক্রান্ত হওয়ার পরেও তেমন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। বিক্ষোভকারীদের ছোড়া তির এক পুলিশকর্মীর মাথা এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে দেওয়ার পরেও বলা হয়েছিল, সেখানকার মানুষের ‘দোষ’ নেই। পুলিশ ‘সংযম’ দেখিয়েছে। সেই ‘সংযম’ই ব্যুমেরাং হয়ে ফিরছে বলে মন্তব্য করেছেন ওই পুলিশকর্তারা। তাঁদের বক্তব্য, বীরভূমে শাসক দলের জেলা সভাপতি প্রকাশ্যে পুলিশকে বোমা মারার কথা বলছেন। মূলত পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করতেই এ-সব বলা হচ্ছে বলে জানান ওই পুলিশকর্তারা।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.