পঞ্চায়েত ভোটের দু’দিন আগে এক তৃণমূল কর্মী খুনের ঘটনায় ফের উত্তপ্ত দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়। যে ঘটনার জেরে সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সাত্তার মোল্লা-সহ ছ’জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এই দলে সিপিএমের দুই পঞ্চায়েত প্রার্থীও রয়েছেন। সাত্তার মোল্লাকে অবশ্য পুলিশ তাদের হেফাজতে নেয়নি। তাঁকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। আর সেই সূত্র ধরেই ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছে সিপিএম। তাদের বক্তব্য, ভোটের আগে সাত্তারকে পরিকল্পনা করেই জেলে ঢোকানো হল।
মঙ্গলবার গভীর রাতে বাড়িতে ঘুমিয়ে থাকার সময় গুলি করে খুন করা হয় ভাঙড়ের ঘুংড়িআইট গ্রামের বাসিন্দা, নজরুল মোল্লা (৪৫) নামে ওই তৃণমূল কর্মীকে। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় সিপিএমের প্রভাবশালী নেতা সাত্তার মোল্লার নির্দেশেই দুষ্কৃতীরা তাঁর ভাইকে খুন করেছে বলে এফআইআর করেন নিহতের ভাই মহসিন মোল্লা। নজরুলের স্ত্রীও একই অভিযোগ করেছেন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে দেড় কিলোমিটার দূরে শাকসর গ্রামে বাড়ি থেকে সাত্তারকে গ্রেফতার করা হয়। ধৃতবাকি পাঁচ জন আশপাশের এলাকার বাসিন্দা।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার এই অঞ্চলটি দীর্ঘদিন ধরেই সিপিএম-তৃণমূলের প্রবল দ্বন্দ্বের জায়গা। চলতি বছরের গোড়া থেকেই দু’দলের মধ্যে সংঘর্ষে তেতে ছিল ভাঙড়। এ বছরের গোড়ায় ভাঙড়ে রেজ্জাককে মারধরের প্রতিবাদে সিপিএমের মিছিল আক্রান্ত হয়েছিল বামনঘাটায়। সেই হামলায় নেতৃত্ব দিয়ে গুলি ছোড়ার অভিযোগ ওঠে তৃণমূল নেতা তথা প্রাক্তন বিধায়ক আরাবুল ইসলামের বিরুদ্ধে। আরাবুল আবার সাত্তারের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার পাল্টা অভিযোগ করেছিলেন। হাইকোর্ট থেকে জামিন নেন জেলায় সিপিএমের অন্যতম সংগঠক।
এ বার সেই খুনের ষড়যন্ত্রেই অভিযুক্ত সাত্তার। |
কী হয়েছিল মঙ্গলবার? নজরুলের পরিবারের তরফে জানানো হয়েছে, রাত ১২টা নাগাদ ঘরের বারান্দায় ঘুমোচ্ছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী লেকজান বিবি। অভিযোগ, সেই সময়েই তাঁকে গুলি করা হয়। গুলিটি তাঁর বুকে ঢুকে বেরিয়ে যায়। পরে গুলিটি উদ্ধার করে পুলিশ। নজরুলের ভাই মহসিন বলেন, “গুলির আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে যায়। এসে দেখি বৌদি কাঁদছেন।” গাড়িতে চাপিয়ে নজরুলকে চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন। মহসিনের অভিযোগ, “তৃণমূল করার জন্য বছরখানেক আগেই সাত্তার মোল্লা একাধিক বার আমাদের শাসিয়েছিলেন। ওরাই পরিকল্পিত ভাবে খুন করেছে।” নজরুলের স্ত্রী লেকজান বিবির বক্তব্য, “গুলির শব্দে আমাকে ঘুম থেকে উঠতে দেখেই উনি (নজরুল) বলেন, সাত্তার মোল্লা আমাকে খুন করল। তার পরেই চুপ করে যান।” রাতেই পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। ধরা হয় সাত্তারকে।
আর এই গ্রেফতারের ঘটনাতেই রাজনীতি দেখছে সিপিএম। সাত্তারকে পুলিশ বুধবার নিজেদের হেফাজতে না চাওয়ায় তাঁকে জেলহাজতে পাঠিয়েছে আদালত। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেও সরব হয়েছে সিপিএম। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের বক্তব্য, “তৃণমূল নেতারা বলছেন, সাত্তারের নির্দেশে খুন হয়েছে। তা হলে তো মূল চক্রী সাত্তারকে নিজেদের হেফাজতে নেওয়ার চেষ্টা করত পুলিশ! এখন বোঝা যাচ্ছে তদন্তের স্বার্থে নয়, ভোটের আগে পরিকল্পনা করে সাত্তারকে জেলে পোরাই পুলিশ-প্রশাসনের মূল উদ্দেশ্য ছিল!”
দু’দিন বাদেই দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ভোট। তার ঠিক আগে জেলায় দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক গ্রেফতার হওয়ায় প্রতিবাদে মুখর সিপিএম নেতৃত্ব। সিপিএমের জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তীর অভিযোগ, “ভাঙড়-২ ব্লকে জোর করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কিছু আসন জিতলেও ভাঙড় ১-এ তাদের লড়তে হবে। মানুষ আমাদের পক্ষে জেনেই চক্রান্ত করে সাত্তার মোল্লা-সহ আমাদের ছ’জনকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে এলাকা থেকে সরিয়ে দিল তৃণমূল!” তাঁর আরও বক্তব্য, “ওদের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের ফল আমাদের ভুগতে হচ্ছে।” বিধায়ক রেজ্জাক বলেন, “সাত্তার ছাড়া অভিযুক্তদের কয়েক জন পঞ্চায়েতের প্রার্থী। তাঁদের হারানোর জন্যই তৃণমূলের এই চক্রান্ত।” শাসকদল অবশ্য এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। নিহতের বাড়িতে এসে এ দিন তৃণমূলের জেলা চেয়ারম্যান শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “সাত্তার মোল্লার নির্দেশেই ভাঙড় এলাকায় আমাদের কর্মী-সমর্থকদের খুন করা হয়। এই খুনও তাঁর নির্দেশেই হয়েছে।”
ধৃত ছ’জনকে এ দিন বারুইপুর আদালতে হাজির করানো হয়। সইফুদ্দিন মোল্লা ও আছের সাঁপুই নামে দুই সিপিএম কর্মীকে চার দিন পুলিশ হেফাজত এবং সাত্তার-সহ বাকি চার জনকে ১৪ দিন জেলহাজতে রাখার নির্দেশ দেন বিচারক। তদন্তকারীদের অনুমান, পরিচিত কেউ খোলা জানলা দিয়ে ওয়ান-শটার থেকে গুলি করে নজরুলকে। নজরুল গরু কেনাবেচার ব্যবসা করতেন। ফলে, নিছক রাজনৈতিক শত্রুতার কারণে, নাকি ব্যবসা সংক্রান্ত কোনও বিবাদ থেকে খুন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জেলার পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠী বলেন, “অভিযোগের ভিত্তিতে ছ’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আরও ছ’জন পলাতক। তাদের খোঁজ চলছে।” |