বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ-সংক্রান্ত মামলার জন্য বিশেষ আদালত বা ওয়ার ট্রাইব্যুনাল অতি সম্প্রতি যে রায়টি দিল, তাহা সত্য অর্থেই ঐতিহাসিক। চার দশক ধরিয়া দেশের সর্বাধিক বিতর্কিত ব্যক্তির বিষয়ে একটি চূড়ান্ত বিচারবিভাগীয় সিদ্ধান্তে পৌঁছাইতে পারা সহজ কথা নহে। এই গোলাম আজম-ই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের মুখ্য দালাল হিসাবে স্বনিযুক্ত ছিলেন, আক্ষরিক অর্থে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষকে মৃত্যুমুখে ঠেলিয়া দিয়াছিলেন, হিন্দু নাগরিকদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার ও নিধনযজ্ঞে পৌরোহিত্য করিয়াছিলেন, উনিশশো একাত্তরের পর যিনি দেশ ছাড়িয়া পলাইতে বাধ্য হইয়াছিলেন এবং মুজিব-হত্যার পর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে দেশে ফিরিয়া আসিবার সুযোগ পাইয়াছিলেন। প্রত্যাবর্তনের পর গোলাম আজমের এই পাকিস্তানি দালাল বনাম রাজাকার ‘গরিমা’ দেশের মধ্যে তাঁহাকে উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক জাতীয়তার প্রধান মুখ করিয়া তোলে, ক্রমে জামাত-এ-ইসলামির নায়ক হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। নবতিবর্ষীয় এই বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব যে জীবনের শেষ প্রান্তে আসিয়া ছাড় পাইলেন না, ‘নব্বই বৎসরের’ কারাদণ্ডের কোপ যে শেষ পর্যন্ত তাঁহার উপর নামিয়া আসিল, ইহার মধ্যে এক প্রকার ঐতিহাসিক ন্যায়ের সন্ধান মেলে।
অনুমান করা যায়, বিশেষ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে তাঁহার পক্ষ হইতে উচ্চতর আদালতে আপিল যাইবে। কিন্তু তাহাতে এই রায়ের ঐতিহাসিকতা কমে না। এই রায়ের ফলে নিশ্চিত ভাবেই আওয়ামি লিগ প্রশাসনের উপর নামিয়া আসিবে উগ্রপন্থী রাজনীতির তীব্র আঘাত। শাহবাগ-আন্দোলনের পরবর্তী ঘটনাক্রম ও সাম্প্রতিক নির্বাচন চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়াছে, ধর্মান্ধ রাজনীতি এই মুহূর্তে বাংলাদেশের কত বড় একটি অংশের উপর প্রভাবশীল। গোলাম আজমের দণ্ডাদেশ এই ধর্মান্ধ সরকারবিরোধী রাজনীতিকে সহিংস করিয়া তুলিবে। বস্তুত ইতিমধ্যেই রাজধানী ঢাকা হইতে শুরু করিয়া কুমিল্লা, বগুড়ার মতো আঞ্চলিক শহর রক্তাক্ত সংঘর্ষে লিপ্ত, প্রতি জেলায় পুলিশের সহিত উন্মত্ত জনতার খণ্ডযুদ্ধ। ইহা অপ্রত্যাশিত ছিল না। তবে কিনা, সংঘর্ষ ও প্রাণক্ষয়ের ভয় সত্ত্বেও এই বিচার জরুরি ছিল। এত বড় অভিযোগে যিনি অভিযুক্ত, স্বাধীন দেশের কোনও-না-কোনও আদালতে জীবদ্দশায় তাঁহার দণ্ডপ্রাপ্তি প্রয়োজনীয় ছিল। নতুবা বিষয়টির শেষ ঘটিত না। বাংলাদেশের জাতীয় মননে একটি বড় ক্ষত থাকিয়া যাইত। জাতীয় ইতিহাসেও।
তুলনায়, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ও সামাজিক গোষ্ঠীগুলির পক্ষ হইতে হরতাল আহ্বান, কিংবা গোলাম আজমের কারাদণ্ডের বদলে ফাঁসির দাবিতে রাস্তায় নামিয়া গোলযোগ বাধাইবার প্রয়াস সত্যই জরুরি কি না, তাহা প্রশ্নযোগ্য। যদিও-বা গোলাম আজমের অপরাধের তুলনায় এই দণ্ড যথেষ্ট বলিয়া না ঠেকে, তবু সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা-সাপেক্ষে এ ভাবে প্রকাশ্য সরকার-বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে উল্টা দিকে উগ্রপন্থীদের সুবিধা করা রাজনৈতিক সুবিবেচনার কাজ নহে। এই যুগল চাপ আওয়ামি লিগ সরকারকে দ্বিগুণ বিপন্ন করিয়া দিতে বাধ্য। নব্বই বৎসরের বৃদ্ধের জন্য নব্বই বৎসর কারাদণ্ড কার্যকর হওয়া বাস্তবসম্মত না হইলেও, এই রায়ের প্রতীকী গুরুত্বটি স্বীকার করা জরুরি। যে অপরাধীর সাজা চার দশক যাবৎ প্রতীক্ষিত ও অবজ্ঞাত, তাঁহার অবশিষ্ট জীবনের কারাবাসটুকু নিশ্চিত করাই একটি বড় পদক্ষেপ নয় কি? কোন তীব্র কষ্ট ও আবেগ হইতে সাধারণ মানুষ দলে দলে গোলাম আজমের ফাঁসির দাবিতে রাজপথে নামিতেছেন, বোঝা কঠিন নয়। কিন্তু বিচার ও শাস্তির প্রক্রিয়াটি যেমন একটি দীর্ঘকালীন অভিযোগের অন্ত সূচিত করে, তেমনই, আবেগ যতই দীর্ঘকালীন হউক, তাহাতেও এক দিন দাঁড়ি টানিয়া বাস্তবসম্মত রাজনীতির জমিতে পা রাখিতে হয়। |