সুদূর পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট একটি দেশ, গ্যাবন। তার সঙ্গেই এখন ভাগ্য জড়িয়ে গিয়েছে কলকাতা তথা এ রাজ্যের সাত-সাতটি পরিবারের।
|
শিশির ওয়াহি। |
কী ভাবে? আশঙ্কা করা হচ্ছে, গ্যাবনের জেন্টিল বন্দরের কাছে জলদস্যুদের কবলে পড়েছে একটি পণ্যবাহী জাহাজ। সেই জাহাজের ক্যাপ্টেন শিশির ওয়াহি (৬৪), কলকাতার বাসিন্দা। তাঁর সঙ্গে ওই জাহাজে রয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের আরও ছ’জন। বাকি ১৭ জন ভারতেরই অন্যান্য রাজ্যের বাসিন্দা। ‘গেডেন’ নামে তুরস্কের একটি সংস্থা এই জাহাজের মালিক।
৮/২-এ আলিপুর পার্ক রোডের বহুতলে শিশিরবাবুর ফ্ল্যাট। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ সেখানেই ‘গেডেন’-এর মুম্বই শাখা অফিস, ‘ভি-শিপ’ থেকে একটি ফোন আসে। জানানো হয়, জাহাজটির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। এর ঘণ্টা দুয়েক পর শিশিরবাবুর স্ত্রী প্রীতি ওয়াহি নিজে আবার মুম্বই অফিসে ফোন করেন। তখন তিনি জানতে পারেন, পশ্চিম আফ্রিকার গ্যাবনের নিকটবর্তী জেন্টিল নামে বন্দরের কাছে জলদস্যুদের কবলে পড়েছে ‘এম টি কটন’ জাহাজটি। খবর শোনার পরেই দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রীতিদেবী এবং শিশিরবাবুর বৃদ্ধা মা। দুশ্চিন্তায় ছটফট করছেন মেয়ে রিচা।
শিশিরবাবু সম্পর্কে নাট্যকর্মী ডলি বসুর দাদা। খবর পেয়ে এ দিন দুপুরে ডলিদেবীও আলিপুরে দাদার বাড়িতে যান। তিনি বলেন, “শুধু দাদা নয়, আমরা জানতে পারছি পশ্চিমবঙ্গের আরও ছ’জন ওই জাহাজে রয়েছেন। কিন্তু তাঁদের কোনও যোগাযোগ নম্বর বা ঠিকানা না-থাকায় আমরা তাঁদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারছি না।”
|
বাবা কেমন আছেন, খবরের অপেক্ষায় উদ্বিগ্ন রিচা। মঙ্গলবার বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি। |
তবে সংবাদমাধ্যম সূত্রে মুম্বইয়ে ফোন করে জানা যায় জাহাজে থাকা পশ্চিমবঙ্গের আরও ছ’জনের মধ্যে এক জন মালদা টাউনের বাসিন্দা জিন্নত হাসান (২২)। কলকাতার তারাতলা মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে ২০১২ সালে পাশ করেছেন বলে তাঁর পরিবার সূত্রের খবর। জিন্নতের দাদা জানান, এম টি কটনেই তাঁর প্রথম হাতেকলমে প্রশিক্ষণ হচ্ছিল।
মুম্বই অফিস জানিয়েছে, সোমবার সকাল ১০টার পর থেকে ‘এম টি কটন’-এর সঙ্গে তুরস্কে গেডেন-এর মূল অফিসের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। জাহাজটিতে গ্যাস ও রাসায়নিক ভর্তি রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলে জাহাজের প্রতিটি সদস্যের বাড়িতে খবর দেওয়া হয়। সেই মতোই জাহাজের প্রত্যেক সদস্যের বাড়িতে খবর পাঠিয়েছে সংস্থাটি। সংস্থার তুরস্কের অফিস থেকে গ্যাবনে খোঁজ নেওয়া হয়েছে। ওখানকার বন্দরের এজেন্ট মারফত সংস্থাটি জেনেছে, জেন্টিলের কাছে মাঝসমুদ্রে জলদস্যুদের কবলে পড়েছে ‘এম টি কটন’।
শিশিরবাবুর পরিবার সূত্রেই খবর, শিশিরবাবুর এই পেশায় প্রায় ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু এর আগে কখনও তিনি জলদস্যুদের কবলে পড়েননি। দুশ্চিন্তা তাই আরও বেশি। গত ৫ জুলাই শিশিরবাবু গ্যাবনের উদ্দেশে রওনা হন। সেখানে পৌঁছে তিনি ‘এম টি কটন’ জাহাজের ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব নেন ১২ জুলাই। তবে গন্তব্যস্থল সম্পর্কে পরিবারকে কিছু জানাননি শিশিরবাবু।
|
শিশিরবাবুর মেয়ে, ৩৪ বছরের রিচা এ দিন বিকেলে তাঁদের আলিপুরের বাড়িতে বসে জানালেন, গত রবিবার দুপুর দেড়টায় তাঁর বাবা পাঁচ-সাত মিনিটের জন্য বাড়িতে ফোন করেছিলেন। এখনও পর্যন্ত ওটাই শিশিরবাবুর সঙ্গে টেলিফোনে তাঁর পরিবারের শেষ কথোপকথন। তবে ওই দিনই বিকেলে শিশিরবাবু ফের তাঁর স্ত্রী ও কন্যাকে ই-মেল করে জানান, জাহাজের স্যাটেলাইট-সংযোগে সমস্যা হয়েছে। এর পর বাড়ি থেকে মেল করলে তিনি পাবেন না। তাই তাঁর পরবর্তী মেল বা ফোনের জন্য বাড়ির লোকজন যেন অপেক্ষা করেন। রিচা জানালেন, একই ই-মেল শিশিরবাবু লন্ডনে তাঁর ছেলে সিদ্ধার্থকেও পাঠিয়েছেন। রিচা বলেন, “বাবা জাহাজে থাকলে সাধারণত প্রতি রবিবার বাড়ির ল্যান্ড ফোনে ফোন করেন। গত রবিবারও যখন ফোন করেছিলেন, স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলেছিলেন। আর তার পর বিকেলে ই-মেল।” তবে জাহাজ থেকে মাঝেমধ্যেই স্যাটেলাইট-সংযোগের সমস্যা হয়ে থাকে এবং তেমন হলে শিশিরবাবু তা সাধারণত বাড়িতে জানিয়েই দিতেন। তাই রবিবার ওই ই-মেল পেয়ে এবং সোমবার সারা দিন যোগাযোগ না-হওয়ার পরেও কোনও দুশ্চিন্তা হয়নি বাড়ির লোকজনের। কিন্তু মঙ্গলবার সকালে মুম্বইয়ের ফোনটা গোটা বাড়িটার ছবি বদলে দিয়েছে। |