ভোট চলাকালীন বুথে ঢুকে কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করল পুলিশ। কেতুগ্রাম ২ ব্লকের নিরোল গ্রাম থেকে সোমবার রাতে তাদের ধরা হয়। ধৃত দু’জনকে জেরা করে স্কুলের পাশে ঝোপ থেকে পুলিশ দু’টি পাইপগান উদ্ধার করেছে।
নিরোল গ্রামের বাসিন্দারা জানান, গ্রামের উচ্চ বিদ্যালয়ে দু’টি বুথে সুষ্ঠু ভাবে নির্বাচন হচ্ছিল। বিকেল ৩টে নাগাদ কেতুগ্রাম ১ ব্লকের খলিপুর ও বামুনডিহি গ্রাম থেকে তিনটি মোটরবাইকে করে ছ’জন স্কুলের মধ্যে ঢোকে। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, তাদের ঢুকতে দেখে গ্রামের তৃণমূল কর্মী নূপুর খাঁড়াইত চলে আসেন। সবাই মিলে বুথে ঢুকে পড়েন। বুথের পাশেই ক্যান্টিন চালাচ্ছিলেন নবনারায়ণ মণ্ডল। তাঁর অভিযোগ, “দুষ্কৃতীদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। তারা ভোটারদের বুথে ঢুকতে নিষেধ করে দেয় ও নিজেরাই সব ভোট দিয়ে দেবেন বলে জানায়।” সিপিএম, কংগ্রেস ও নির্দল জানায়, প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে ছাপ্পা চলার পরে একজোট হয়ে স্কুলের ভিতরে ঢুকে তারা প্রতিবাদ করে। |
গ্রামবাসীরা জানান, পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ছ’জন দুষ্কৃতীই স্কুলের ছাদে চলে যায়। পরে তাদের মধ্যে দু’জন ছাদ থেকে নেমে স্কুলের পিছনে মাঠ ধরে চম্পট দেয়। ততক্ষণে গ্রামের মহিলারা বঁটি, লাঠি, ঝাঁটা নিয়ে স্কুলের ভিতরে ঢুকে পড়েছে। পুলিশ গ্রামবাসীর হাতে প্রহৃত হওয়া থেকে দুষ্কৃতীদের বাঁচাতে স্কুলের একটি ঘরে ঢুকিয়ে তালা লাগিয়ে দেয়। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, এর পরেই স্কুলের পিছনের মাঠে বোমাবাজি ও গুলি চলে। গ্রামের বাসিন্দা কার্তিক থান্ডার, সোমনাথ থান্ডার, শ্যামসুন্দর থান্ডারেরা অভিযোগ করেন, দুষ্কৃতীদের ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে খলিপুর ও রাউন্দির দিক থেকে বোমা-গুলি ছুড়ছিল দুষ্কৃতীরা। তাদের আটকানোর জন্য তাঁরা পাল্টা পাথর ও ইট ছোড়েন।
পুলিশের ভূমিকা নিয়েও ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী। তাঁদের অভিযোগ, পুলিশের সামনেই বোমা পড়েছে, গুলি চলেছে। কিন্তু পুলিশ ছিল নির্বিকার। কেন্দ্রীয় বাহিনীরও দেখা মেলেনি। বোমার টুকরো লেগে গুরুতর জখম হন নিরোলের এক বাসিন্দা। তিনি কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি।
গ্রামবাসীরা জানান, দুষ্কৃতীদের হাত থেকে বুথ বাঁচাতে মহিলারাই প্রথম এগিয়ে গিয়েছিলেন। প্রায় সত্তর জন মহিলা লাঠি-ঝাঁটা-বঁটি নিয়ে দুষ্কৃতীদের তাড়া করেছিলেন। বাসন্তী মাঝি, জয়ন্তী মাঝিদের অভিযোগ, “নিরোল গ্রামে এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। আমাদের উপরে আক্রমণ হতে পারে ভেবেও আমরা এগিয়ে গিয়েছিলাম।”
মঙ্গলবার নিরোল উচ্চ বিদ্যালয়ে পুলিশ-পিকেট রয়েছে। এ দিন দুপুরে বামুনডিহি ও খলিপুরের চার জন ও নিরোল গ্রামের এক জনকে পুলিশ আদালতে নিয়ে যাওয়ার পরেই গ্রামের কিছু বাসিন্দা স্কুলের মধ্যে থাকা পুলিশের কাছে দোষীদের শাস্তি চেয়ে বেশ কিছুক্ষণ বিক্ষোভ দেখান। বিকেলে গ্রামের শান্তিরক্ষা কমিটি দলমত নির্বিশেষে একটি বৈঠক করেন। সেখানে বহিরাগতেরা গ্রামে হামলা চালাতে পারে আশঙ্কা করে রাত পাহারার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে একটি সূত্রের খবর।
বুথে ঢুকে কাজে বাধার ঘটনা প্রসঙ্গে তৃণমূলের কেতুগ্রাম ২ ব্লক সভাপতি দেবাশিস মণ্ডলের পাল্টা দাবি, “সিপিএম, কংগ্রেস পরিকল্পিত ভাবে এই ঘটনা ঘটিয়েছে।” তৃণমূলের আরও অভিযোগ, মঙ্গলবার সকালে সিপিএম ও কংগ্রেস যৌথ ভাবে দলের নেতা-কর্মীদের বাড়িতে হামলা চালিয়েছে। তার জেরে অনেক কর্মী গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। যাঁরা বাড়িতে রয়েছেন, দরজা-জানালা বন্ধ করে আতঙ্কের মধ্যে বাস করছেন। নিরোল গ্রামের বাসিন্দা, তৃণমূলের জেলা পরিষদের প্রার্থী অনুভা সাহার অভিযোগ, “আমরা ঘরের বাইরে বেরোতে পারছি না। সিপিএম এবং কংগ্রেস আমাদের বাড়িতে চড়াও হয়েছিল।” সিপিএম এবং কংগ্রেস, দু’পক্ষই হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, গোলমালের মধ্যে এখন আর কোনও রাজনীতি নেই, সেটি গ্রামীণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নিরোলে ধৃত পাঁচ জনের মধ্যে আপেল শেখ, কমরেড শেখ, টগর শেখ ও পিন্টু শেখের বাড়ি বামুনডি খলিপুর এলাকায়। অপর ধৃত, বছর চৌষট্টির আশুতোষ মজুমদার নিরোল গ্রামেরই বাসিন্দা। মঙ্গলবার কাটোয়া আদালতে তোলা হলে বিচারক ধৃতদের ১৪ দিন জেল হাজতে রাখার নির্দেশ দেন। কাটোয়া আদালতের সরকারি আইনজীবী প্রবীর রায় বলেন, “কেতুগ্রাম ছাড়াও কাটোয়া ও মঙ্গলকোট থেকে পুলিশ ছাপ্পা ভোট দেওয়ার অভিযোগে দু’জন করে মোট চার জনকে গ্রেফতার আদালতে পাঠিয়েছিল। তাদেরও ১৪ দিন জেল হাজতের নির্দেশ দেন বিচারক।” |