প্রচণ্ড শব্দে ফেটেছে বোমাটা। ধোঁয়া সামান্য হাল্কা হতে দেখা গেল, রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে আছেন ৩৫ বছরের শেখ হাসমত সাগা। এ বারে ভোটের দিনে হিংসার প্রথম বলি। তাঁর পেটের ভয়াবহ ক্ষত থেকে তখন রক্ত বেরোচ্ছে। কিছু দূরে ভোটের লাইন ভেঙে গিয়েছে। ভোটাররা ত্রাসে ছুটছেন এদিক ওদিক। একটু পরে কয়েক জন এসে তোলার চেষ্টা করলেন দেহটি, যদি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যায়!
কিন্তু কোথায় কেন্দ্রীয় বাহিনী? বা সশস্ত্র পুলিশ?
এর ৪০ মিনিট পরে ওই এলাকায় গরু খোঁজা খুঁজে এক ডেরা থেকে বার করে আনা হয় রাজকুমার কোড়া (৩১) নামে এক যুবককে। ওই বহিরাগতই বোমা ছোড়ার পিছনে এমন অভিযোগ তুলে গণধোলাই দিয়ে ওখানেই মেরে ফেলা হয় তাঁকে।
কেন্দ্রীয় হোক বা রাজ্য পুলিশ, বাহিনী তখনও অদৃশ্য।
সোমবার সাতসকালে পঞ্চায়েত ভোটের দ্বিতীয় দফায় এ ভাবেই রক্তাক্ত হল বর্ধমানের জামুড়িয়া এলাকার মদনতোড়।
প্রায় একই ছবি মঙ্গলকোটেও। সেখানকার পূর্ব নওয়াপাড়া গ্রামে তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষে বোমা ফেটে মৃত্যু হয় এক জনের।
তাঁর নাম শাহিদুল্লা মল্লিক (৩৭)। |
ঘণ্টা দেড়েক ধরে চলে বোমা-গুলির লড়াই।
সেখানেও দেখা মেলেনি কেন্দ্রীয় বাহিনীর।
তা হলে কোথায় গেল তারা? মহাকরণেরই তথ্য বলছে, বড়সড় অশান্তির আশঙ্কায় সিআরপিএফ এবং ভিন রাজ্যের পুলিশ মিলিয়ে শুধু বর্ধমানেই ৫৮ কোম্পানি বাহিনী পাঠানো হয়েছিল। একই ভাবে কেন্দ্রীয় বাহিনী গিয়েছিল হুগলি ও পূর্ব মেদিনীপুরেও। পরের দুই জেলায় কোনও প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও অশান্তির বহর খুব একটা কম ছিল না। তা সত্ত্বেও বুথ জ্যাম কিংবা ব্যালট ছিনতাইয়ে বাধা দিতে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি কেন্দ্রীয় বাহিনীকে। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “কোথায় কত কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হবে, তা দেখার দায়িত্ব জেলাশাসকের। তাঁরা যেখানে যেমন বুঝেছেন, বাহিনী দিয়েছেন।”
তা হলে কেন দেখা মিলছে না কেন্দ্রীয় বাহিনীর? বুথে তো নেই-ই, বুথের বাইরেও প্রায় অদৃশ্য। কেন?
মহাকরণের এক কর্তার ব্যাখ্যা, “আদালত বলেছিল সমস্ত স্পর্শকাতর ও অতি স্পর্শকাতর বুথে সশস্ত্র পুলিশ রাখতে হবে। আমরা সেই নির্দেশই মেনেছি।” হাইকোর্ট তখন বলেছিল অতি স্পর্শকাতর বুথে দু’জন সশস্ত্র পুলিশ ও দু’জন কনস্টেবল, আর স্পর্শকাতর বুথে দু’জন করে সশস্ত্র পুলিশ দিতে হবে। বিরোধীদের অভিযোগ, আদালতের এই নির্দেশের ফাঁকই ব্যবহার করা হয়েছে। সেটা করতে গিয়েই কেন্দ্রীয় বাহিনী পেয়েও রাজনৈতিক স্বার্থে তাদের নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে শাসকদল। তাঁদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করার ব্যাপারে প্রথম থেকেই গররাজি ছিল রাজ্য সরকার। এ ভাবে তারা সেই জেদ বজায় রাখল।
ভোটের আগে রাজ্যের এক মন্ত্রীর কথাতেও এমনই ইঙ্গিত ছিল বলেও অভিযোগ করেছেন বিরোধীরা। তিনি তখন বলেছিলেন, “লোকসভা বা বিধানসভার ভোটে রাজ্যের পুলিশ ওদের (কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন) আওতায় চলে যায়। আর পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী এলেও ওরা তো আমাদেরই এসপি-ডিএমদের অধীনে থাকবে।” সেই দৃষ্টান্ত টেনে এ দিন বিরোধীদের বক্তব্য, উনি যা বলেছিলেন, বাস্তবে তা-ই তো হল!
প্রাণহানির এই ঘটনার পরে এ দিনের ভোট আর শান্তিপূর্ণ বলছেন না রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে। তিনি বলেন, “ভোট শান্তিপূর্ণ হয়েছে, বলতে পারছি না।” কেন হিংসা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। জানিয়েছেন, শুধু বর্ধমানেই ২২টি বুথে পুনর্নির্বাচন হতে পারে। বাহিনী মোতায়েন নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মীরার জবাব, “এই নিয়ে সরকারি ভাবে কোনও খবর পাইনি। তবে বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছি, মোতায়েন ঠিকমতো হয়নি।”
কী ভাবে বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে? মহাকরণের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ভোটের দু’দিন আগেই জেলার পুলিশ-প্রশাসনের আধিকারিকদের ফোন করে কী ভাবে কেন্দ্রীয় বাহিনী ব্যবহার করতে হবে, সে কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, কেন্দ্রীয় বাহিনী রাখা যাবে পুলিশ লাইনে, থানায়, কন্ট্রোল রুমে, সেক্টর অফিসে, পর্যবেক্ষদের নিরাপত্তায় এবং হেভি রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াডে। আর রাখা যাবে এলাকায় টহলদারিতে (এরিয়া ডমিনেশন)। প্রশাসনের একটি অংশের বক্তব্য, সে কারণেই বহু স্পর্শকাতর ও অতি স্পর্শকাতর বুথে দেখা মেলেনি কেন্দ্রীয় বাহিনীর। বিরোধীদের অভিযোগ, তাই বোমাবাজি, মারামারি, প্রাণহানি এবং অবাধে বুথ দখল হয়েছে। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সচিব তাপস রায় রাতে বলেন, “বুথে যে সংখ্যক সশস্ত্র পুলিশ থাকার নির্দেশ হাইকোর্ট দিয়েছিল, এ দিন তা ছিল। তবে তাদের মান কেমন ছিল, তা নিয়ে এখনই কোনও মন্তব্য করছি না।”
সিপিএম এর মধ্যে অভিযোগ তুলেছে, কেন্দ্রীয় বাহিনীর পোশাকে টহল দিয়েছে রাজ্যের পুলিশ ও হোমগার্ডরা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেন, “কাঁথিতে এক হোমগার্ডকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর পোশাক পরিয়ে হাতে থ্রি নট থ্রি রাইফেল ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।” জানা গিয়েছে, ওই ব্যক্তির নাম স্বপন মজুমদার। তিনি আলিপুর বডিগার্ড লাইনের পুলিশকর্মী। কাঁথি ৩ নং ব্লকের দুরমুঠ গ্রাম পঞ্চায়েতের দইসাই বুথে তাঁকে দুপুর সাড়ে ১১টায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর পোশাকে দেখা যায়। খবর চাউর হতেই আধ ঘণ্টার মধ্যে পোশাক বদলে ফের পুলিশের পোশাক পরে নেন তিনি। বর্ধমানের বৈকুণ্ঠপুরেও দেখা গিয়েছে জলপাই পোশাক পরে হাতে লাঠি নিয়ে ভোটের ডিউটি করছেন ঝাড়গ্রামের এক এনভিএফ। |
কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের অভিযোগ, রাজ্য পুলিশের অনেক কর্মীকে জংলা পোশাক পরিয়ে এ দিন কেন্দ্রীয় বাহিনী সাজানো হয়েছিল।
বিরোধীদের অভিযোগ উড়িয়ে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, “এ ধরনের কাজ করার অভ্যাস সিপিএমের আছে। আমাদের নেই। নন্দীগ্রামের আন্দোলন দমন করতে ওঁরা হাওয়াই চপ্পল পরা ক্যাডারদের পুলিশ সাজিয়ে নামিয়েছিলেন। ওঁরা নিজেদের আয়নায় অপরকে দেখছেন।” ভোট শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটার ঠাকুরনগরে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “নির্বাচনে তিন জন মানুষ মারা গিয়েছেন। তাঁরা বামফ্রন্ট হতে পারেন, তৃণমূলও হতে পারেন। এক জায়গায় তৃণমূল তৃণমূলের হাতে খুন হয়েছে। বারুদে আগুন লাগলে নিজের ঘরও পোড়ে। এটা একটা অশনি সঙ্কেত।”
জামুড়িয়ায় গোলমালের ঘটনা ঘটে সওয়া সাতটায়। মদনতোড় পঞ্চায়েতের সিপিএম প্রার্থী মানোয়ারা বিবির স্বামী শেখ হাসমত মধুডাঙা গ্রামের জনা ৫০ মহিলা ভোটারকে নিয়ে কাছেই প্রাথমিক স্কুলে ভোট দেওয়াতে যাচ্ছিলেন। মাঝ রাস্তায় কিছু যুবক তাঁদের ফিরে যেতে বলে। প্রত্যক্ষদর্শী, হাসমতের বৌদি ধনার বিবির অভিযোগ, “তর্কাতর্কির মধ্যেই তৃণমূলের লোকজন হাসমতকে লক্ষ করে বোমা ছোড়ে। ধোঁয়া কাটতে দেখি, ওর দেহটা রাস্তায় পড়ে আছে।” নিহতের স্ত্রী মানোয়ারা বিবি বলেন, “পুলিশের সামনেই ওরা আমার স্বামীকে খুন করল। কার কাছে যাব?”
তৃণমূলের দাবি, হাসমত লোকজন জুটিয়ে বুথ জ্যাম করতে যাচ্ছিলেন। তাঁদের কর্মীরা বাধা দিলে বোমা ছুড়তে গিয়ে নিজের হাতেই ফেটেছে। তখন বুথে পাঁচ পুলিশ ছিলেন, দু’জন সশস্ত্র। খুনের খবর পেয়ে জনা কুড়ি পুলিশকর্মী, পাঁচ
|
মীরা পাণ্ডে,
রাজ্য নির্বাচন কমিশনার |
জন সিআইএসএফ এবং চার জন আইআরবি জওয়ান আসেন। তত ক্ষণে সিপিএমের লোকেরা আততায়ীদের আঁতিপাঁতি করে খুঁজছে। স্থানীয় সূত্রের খবর, ঘটনাস্থল থেকে শ’দেড়েক মিটার দূরে একটি পোড়োবাড়িতে কয়েক দিন ধরে কিছু বহিরাগত যুবক ডেরা গেড়েছিল। মিনিট চল্লিশেক পরে সেখান থেকেই রাজকুমার কোড়াকে বের করে পিটিয়ে-কুপিয়ে খুন করা হয়। অত ক্ষণ ধরে পুলিশ ও আধা সেনা কী করছিল, সেই প্রশ্ন কিন্তু এড়ানো যাচ্ছে না। আসানসোল-দুর্গাপুরের পুলিশ কমিশনার অজয় নন্দ অবশ্য দাবি করেন, “বুথ থেকে আধ কিলোমিটার দূরে সিপিএম এবং তৃণমূলের লোকজন জড়ো হয়েছিল। এক জন বোমায় খুন হতেই তাঁর দলের লোকেরা অন্য পক্ষের এক জনকে মারতে-মারতে রাস্তার পাশে মাঠে ফেলে চলে যায়। দ্বিতীয় নিহত যুবক জামুড়িয়া পুর এলাকার বাসিন্দা।” তাঁর আরও দাবি, “খবর পেয়েই পুলিশ ও সিআইএসএফ পৌঁছেছে। প্রথম খুনের ঘটনায় দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।”
মঙ্গলকোটের পূর্ব নওয়াপাড়া গ্রামে উত্তেজনা ছিল সকাল থেকেই। সেখানে দলের বিরুদ্ধে তৃণমূলেরই একটি বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী নির্দল প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে। সকাল ১০টায় খেতজমিতে দুই পক্ষের সংঘর্ষ শুরু। চলে ঘণ্টাখানেক। পরে পালানোর সময় বোমা ফেটে তৃণমূল কর্মী শাহিদুল্লা মল্লিক ওরফে কটার মৃত্যু হয়। তাঁর দেহের কাছেই ছড়িয়ে ছিল অ্যালুমিনিয়ামের টুকরো, মাটিতে বেশ কিছু বোমা ফাটার দাগ। পুলিশের অনুমান, বোমার বালতি নিয়ে পালাতে গিয়ে বিস্ফোরণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। যদিও বর্ধমান জেলা তৃণমূল সভাপতি (গ্রামীণ) স্বপন দেবনাথ দাবি করেন, “সিপিএম এবং তাদের সমর্থিত নির্দলরা গ্রামের বুথ দখল করার চেষ্টা করছিল। প্রতিবাদ করায় বোমা মেরে খুন করা হয় শাহিদুল্লাকে।”
|