নিজেদের সাফল্য নিয়ে ভোটারদের দোরে তৃণমূল
মানুষের ক্ষোভ ও দলছুটদের ঘরে ফেরাই ভরসা সিপিএমের
শুরুটা হয়েছিল ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে। সেই সাফল্যের ধরা অব্যাহত রয়েছে লোকসভা এমনকী বিধানসভাতেও। উত্তর ২৪ পরগনার সীমান্ত মহকুমা বনগাঁ ক্রমশই হয়ে উঠেছে তৃণমূলের খাস তালুক। সেই ধারা যাতে বজায় থাকে পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচারে নেমে সেই ভূমিকা পালনে কোনও খামতি রাখছেন না তৃণমূলের নেতারা।
১৯৯৮ সালে প্রথমবারের জন্য বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতি সিপিএম তথা বামেদের হাতছাড়া হয়। সমিতি দখল করে তৃণমূল। ২০০৩ সালে ফের ক্ষমতায় আসে বামেরা। ২০০৮-এ ফের হেরে যায় তারা। ভোটে জয়ী হয়ে সমিতির সভাপতি হন তৃণমূলের সৌমেন দত্ত। সে বার ৪৭টি আসনের মধ্যে তৃণমূল পেয়েছিল ৩৪টি। বামেরা ১১টি এবং বিজেপি জিতেছিল দু’টি আসনে। বনগাঁ উত্তর ও দক্ষিণ, এই দুই বিধানসভা এলাকাতেই রয়েছে বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতির সব আসন। এবং দু’টি বিধানসভাই বর্তমানে তৃণমূলের দখলে।
বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতির অধীনে রয়েছে ১৬টি গ্রাম পঞ্চায়েত। তার মধ্যে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বামেরা পেয়েছিল ৭টি (পাল্লা দিঘারি, ছয়ঘরিয়া, চৌবেড়িয়া-২, গোপালনগর-১, ট্যাংরা ও সুন্দরপুর), তৃণমূলের লধখলে ছিল ৯টি (ধর্মপুকুরিয়া, ঘাটবাওর, কালুপুর, গঙ্গানন্দপুর, চৌবেড়িয়া-১, গোপালনগর-২, বৈরামপুর, গাঁড়াপোতা ও আকাইপুর) গ্রাম পঞ্চায়েত। পরবর্তীতে অনাস্থা ভোটে জিতে সুন্দরপুর পঞ্চায়েত দখল করে তৃণমূল। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও জোর লড়াই চালাচ্ছে সিপিএম। এমনকী ফের ক্ষমতা দখলেরও আশা করছেন তাঁরা।
নাওভাঙা নদীর বর্তমান অবস্থা। পঞ্চায়েত ভোটে যা বিরোধীদের অন্যতম প্রধান দাবি।
কেন জেতার আশা করছেন তাঁরা?
রাজনৈতিক মহলের মতে ‘প্রতিষ্ঠান’ বিরোধী ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই সিপিএমের এই আশা। তা ছাড়া, গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে যে সব পার্টি কর্মী-সমর্থকেরা ক্ষোভে-অভিমানে দল থেকে মুখ ফিরিয়েছিলেন, তাঁরা ফের দলমুখী হতে শুরু করেছেন। যা স্বীকার করেছেন সিপিএম নেতৃত্বও। বনগাঁ-বাগদা জোনাল কমিটির সম্পাদক পঙ্কজ ঘোষ বলেন, “দলের থেকে যাঁরা মুখ ফিরিয়েছিলেন, তাঁরা ফের দলে ফিরছেন। তাই ভোটে জয়ের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।” নির্বাচনের আগে দলীয় কর্মী-সমথর্কদের চাঙ্গা করতে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, প্রাক্তন আবাসনমন্ত্রী তথা দলের জেলা সম্পাদক গৌতম দেবকে দিয়ে কর্মীসভা করানো হয়েছে। সিপিএমের জেলা নেতৃত্বের দাবি, বুদ্ধবাবুর সভার আগে প্রতিটি বুথে প্রচার চালানো হয়েছিল। সেই সময়েই অধিকাংশ পুরনো কর্মী দলে ফিরে এসেছেন। তা ছাড়া প্রচারে তাঁরা জাতীয় ও রাজ্য রাজনীতির পাশাপাশি স্থানীয় সমস্যাগুলিও মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন। পঙ্কজবাবুর অভিযোগ, “গত পাঁচ বছরে বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতি কিছু রাস্তা তৈরি করেছে ঠিকই, কিন্তু চোখে পড়ার মতো কোনও কাজ তারা করতে পারেনি।” আর প্রচারে তা তুলে ধরতে গিয়ে সিপিএম টেনে এনেছে ইছামতী নদীর পূর্ণাঙ্গ সংস্কার না হওয়া, যমুনা ও নাওভাঙা নদীর পাশাপাশি এলাকা জুড়ে যে ৪০টি ছোট-বড় বাওড় রয়েছে সেগুলিরও কোনও সংস্কার না হওয়ায় মহকুমার নিকাশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মতো গুরুতর বিষয়ও। বনগাঁ শহরে যানজটের সমস্যা, আজ পর্যন্ত কোনও কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাস না হওয়া, কৃষি প্রধান এলাকা হওয়া সত্ত্বেও কোনও হিমঘর তৈরি না হওয়া, কিষানমান্ডির শিলান্যাস হয়েও তা পড়ে থাকার মতো বিষয়গুলি নিয়েও তৃণমূলের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছে সিপিএম।
এমন অনেক রাস্তাই পাকা করার দাবি মানুষের।
সমিতির বিদায়ী বিরোধী দলনেতা গোবিন্দ মণ্ডলের অভিযোগ, “বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতা সে ভাবে সমিতি সকলের কাছে পৌঁছে দিতে পারেনি। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের কাজের সুযোগও করে দিতে ব্যর্থ সমিতি। নদী-খাল-বিল সংস্কার না হওয়ায় মত্‌স্যজাবীরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। পাট-সব্জির ন্যায্য দাম পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন কৃষক। তা ছাড়া আমাদের কর্মীদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে। পাঁচ বছরে উন্নয়নের মাপকাঠিতে ১০-এর মধ্যে ৫ পেতে পারে।”
পাল্টা প্রচারে তৃণমূলের অস্ত্র অবশ্যই উন্নয়নমূলক কাজের তালিকা। পাশাপাশি দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে নানা ব্যবস্থা নেওয়ার প্রসঙ্গে তাদের সাফল্যও তুলে ধরছে তৃণমূল। বনগাঁ ব্লকে দলের প্রচারের দায়িত্বে থাকা বিশ্বজিত্‌ দাস কিছুদিন আগে বালিয়াডাঙা থেকে প্রচুর বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশকে সাহায্য করেছিলেন। বিশ্বজিত্‌বাবুর কথায়, বালিয়াডাঙা, নতিডাঙা, শুভরত্নপুর, সাতবেড়িয়া, জানিপুর, আলাকালিপুর, বোয়ালদহ প্রভৃতি এলাকা ছিল দুষ্কৃতীদের স্বর্গরাজ্য। সন্ধ্যার পর কেউ বেরোতে পারতেন না। ওই সব এলাকা থেকে দুষ্কৃতীদের তাঁরা বিতাড়িত করেছেন। এখন সেখানকার মানুষ শান্তিতে আছেন। বালিয়াডাঙার বাসিন্দাদের কথাতেও শোনা গিয়েছে বিশ্বজিত্‌বাবুর দাবির প্রতিধ্বনি। এক মহিলার কথায়, আগে এখানে কেউ ঘরদোর বানাতে সাহস করতেন না। এখন সে সব সমস্যা নেই।
বেশ কিছু এলাকায় অবশ্য তৈরি হয়েছে ঢালাই রাস্তা।
২০০৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর বনগাঁ ব্লকে অরুণ বিশ্বাস, মুকুর গাজি ও ইয়ান নবি তিনজন তৃণমূলের কর্মী খুন হয়েছেন। প্রচারে তাও তুলে ধরেছেন তৃণমূল নেতারা। গত দু’বছরে বিশ্বজিত্‌বাবুর বিধায়ক তহবিলের টাকায় গ্রামীণ এলাকায় ঢালাই রাস্তা, কালভাট প্রভৃতি তৈরি হয়েছে। উন্নয়ন হয়েছে গরিবপুর শ্মশানের। প্রচারে উঠে এসেছে এ সব তথ্য। আর গত পাঁচ বছরে সাফল্যের খতিয়ান হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনা ও বিএডিপি প্রকল্পে ২০০ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ, ৯৮ শতাংশ বাড়িতে বিদ্যুত্‌ পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি গত দু’বছরে ২০ হাজার কিষান ক্রেডিট কার্ড বিলি, ১ লক্ষ ৩ হাজার রেশন কার্ড বিলি, ৫টি নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ প্রভৃতি। প্রচার করা হয়েছে বনগাঁ দক্ষিণ কেন্দ্রের বিধায়ক সুরজিত্‌ বিশ্বাসের বিধায়ক তহবিলের অর্থে উন্নয়নের খতিয়ানও।
তবে সাফল্যের খতিয়ান নিয়ে প্রচারের মধ্যেই বৈরামপুর, গঙ্গানন্দপুর ও ঘাটবাওড় পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে ১০০ দিনের কাজে বা সরকারি গাছ কাটার ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ তৃণমূলের অস্বস্তির কারণ হতে পারে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। তা ছাড়া আকাইপুর, বৈরামপুর ও ছয়ঘরিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতে বেশ কয়েকজন বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতা-কর্মী নির্দল প্রার্থী হওয়ায় সেটাও ভোটের ফলে প্রভাব ফেলতে পারে বলে তাঁদের ধারণা। প্রভাব ফেলতে পারে কয়েকটি এলাকায় কংগ্রেস এবং বিজেপি-র ভোট কাটাকাটিও। এমনকী এ বার পঞ্চায়েত স্তরে কংগ্রেস ও বিজেপি-র ভাল ফল করার সম্ভাবনাও রয়েছে। স্থানীয় সূত্রের খবর, ঘাটবাওড়, গঙ্গানন্দপুর এলাকায় বিজেপি-র শক্তি তুলনায় বেশি।
শাসকদলের প্রচারে সাফল্যের খতিয়ান নিয়ে অবশ্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া শোনা গিয়েছে এলাকার মানুষের কাছে। সেখানে যেমন ইছামতী থেকে কচুরিপানা তোলার ক্ষেত্রে গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে, তেমনই অভিযোগ উঠেছে আইন-শৃঙ্খলা নিয়েও। তবে দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য যে আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে সে ব্যাপারে অনেকেই একমত। তবে সব রাজনৈতিক দলগুলির কাছেই এলাকার মানুষের দাবি, এলাকায় দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করে শান্তি ফেরান।
এখন দেখার, তাঁদের সেই দাবি পূরণের দায়িত্ব তাঁরা কোন দলের হাতে তুলে দেন।

ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.