|
|
|
|
বিরোধী নেই, ভোটে উত্তাপও নেই খেজুরিতে
সুব্রত গুহ • খেজুরি |
কোনও প্রতিরোধ নেই, প্রতিবাদ নেই। আপাত নির্বিঘ্নেই ভোট হয়ে গেল একদা বামদুর্গ খেজুরিতে।
বুথের সামনে কোনও জটলা নেই। দু’-একটা মারধরের বিক্ষিপ্ত অভিযোগ ছাড়া বড় গণ্ডগোলও হয়নি। এমনকী বুখে লোকজনও খুব কম। নিস্পৃহ মুখে যাঁরা লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, হাজার চেষ্টাতেও মুখ খুলছেন না তাঁরা। সাধ্য-সাধনায় জাহানাবাদ বুথের এক বৃদ্ধ মুখ খুললেল। নিচু গলায় বললেন, “অঙ্কটা কষা হয়ে গিয়েছে আগেই। বিরোধীরা তো মনোনয়নই দিতে পারেনি। যে জায়গায় সামান্য বিরোধিতারও আভাস পেয়েছেন তৃণমূল নেতারা, আগেই বাড়ি-বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়ে এসেছেন। বুথের সামনে গণ্ডগোল করার কৌশল পুরনো হয়ে গিয়েছে।”
কথাটা যে একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার নয়, সেটা পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট। পঞ্চায়েত ভোটে মনোনয়ন-পর্ব মেটার পরেই খেজুরির দু’টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে একটা দখলে পেয়ে গিয়েছে তৃণমূল। আর মোট ১১টা গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৯টিতে ইতিমধ্যেই সংখ্যাগরিষ্ঠ তারা। আসনের হিসাবে ধরলে খেজুরি ১ ও ২ ব্লকের ১১টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৮৩টি আসনের মধ্যে ১১৫টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গিয়েছে তৃণমূল। এই দুই পঞ্চায়েত সমিতির ৩৩টি আসনের মধ্যে ১৬টিতে তৃণমূল ছাড়া অন্য কোনও দলের প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা দেননি। মাত্র ৬৮টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ১৭টি পঞ্চায়েত সমিতি আর ৪টি জেলা পরিষদ আসনে এ দিন ভোট হয়। স্বাভাবিক ভাবেই ভোট নিয়ে কোনও তাপ উত্তাপ ছিল না।
তবে, বিরোধীশূন্য হয়েও তৃণমূল যে নিশ্চিন্তে আছে, এমনটা নয়। খেজুরির যে ৬৮টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে ভোট হবে, তাতে বামেদের মাত্র দু’জন প্রার্থী রয়েছেন। কংগ্রেসের ৮। পঞ্চায়েত সমিতির ক্ষেত্রেও ১৭টি আসনের মধ্যে সিপিএম ও কংগ্রেস মাত্র ২টি করে আসনে প্রার্থী দিতে পেরেছে। বাকি সব নির্দল প্রার্থীযাঁদের অধিকাংশই তৃণমূলের আদির্পবে দলের সঙ্গে থাকলেও বতর্মানে দলের টিকিট না পেয়ে বিক্ষুব্ধ হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়েছেন। |
নিস্তরঙ্গ খেজুরির কুঞ্জপুর বুথ। —নিজস্ব চিত্র। |
এ দিন মূলত তাঁদের বুথগুলিতেই গণ্ডগোল হয়েছে। যেমন খেজুরি ১ পঞ্চায়েত সমিতির মানসিংহবেড় বুথ। স্থানীয় তৃণমূল কর্মী অন্নপূর্ণা মান্না এ বার টিকিট না পেয়ে পঞ্চায়েত সমিতির আসনে নির্দল হিসাবে লড়ছেন। তাঁর পোলিং এজেন্টকে তৃণমূলের লোকেরা মারধর করে তাড়িয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ। অন্নপূর্ণাদেবী বলেন, “আমার ঘনিষ্ঠদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়ে এসেছে তৃণমূলের লোকেরা। ভোটের দিন বাড়ি থেকে বেরনো চলবে না বলে ফতোয়া দিয়েছিল। তারপরেও পাড়া-পড়শি যাঁরা বেরোতে চাইছিলেন এ দিন, তাঁদের তাড়িয়ে দিয়েছে।
খেজুরির নিজকসবা পঞ্চায়েতেও গণ্ডগোল হয়েছে। তৃণমূলের বিদায়ী পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য দেবাশিস দাস এ বার টিকিট না পেয়ে নির্দল হিসাবে পঞ্চায়েত সমিতির আসনেই দাঁড়িয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, “গত দু’তিন দিন ধরে রাতের বেলা তৃণমূলের লোকেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়ে আসছে। ভয়েই অনেকে বেরোতে চায়নি এ দিন।” নিজকসবাতেই ঢোকার পথে সিপিএম নেতা অসীম মণ্ডল, ডিওয়াইএফ সদস্য সবুজ মাইতিতে আটকে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। তাঁদের মোটর বাইক তৃণমূলের লোকেরা কেড়ে নেয়। থানাতেও অভিযোগ জানিয়েছেন সবুজবাবু।
কংগ্রেস নেতা সোমশঙ্কর মণ্ডল আবার অভিযোগ করেন, “খেজুরি ১ নম্বর ব্লকের দক্ষিণ লাক্ষী পঞ্চায়েতে তৃণমূলের লোকেরা বুথ দখল করে ছাপ্পা ভোট দিচ্ছে দেদার।’’ খেজুরি ২ ব্লকের হলুদবাড়ি এলাকায় চৌদ্দচুল্লি পঞ্চায়েতের কংগ্রেস প্রার্থী কুহেলী প্রধানের স্বামী স্বপনবাবুই পোলিং এজেন্ট হয়েছিলেন। এ দিন তাঁকে মারধর করে তাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে।
এ দিকে, ইচ্ছে থাকলেও ভোট দিতে গ্রামে যেতে পারেননি খেজুরির দাপুটে সিপিএম নেতা হিমাংশু দাস। নন্দীগ্রাম নিখোঁজ মামলায় জামিন পেলেও আদালতের নির্দেশে এলাকায় ঢোকা বারণ তাঁর। কলকাতায় বসে ফোনে এলাকার খোঁজখবর নিচ্ছিলেন হিমাংশুবাবু। আক্ষেপ করে বলেন, “আগেই তো সন্ত্রাস করে অধিকাংশ আসন ছিনিয়ে নিয়েছে তৃণমূল। তারপরও এ দিন নক্কারজনক ভাবে বিভিন্ন জায়গায় বুথ দখল করে ছাপ্পা ভোট দিয়েছে।”
তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য সমস্ত অভিযোগই উড়িয়ে দিয়েছেন। এ দিন খেজুরির আশাভবন পার্টি অফিসে বসে স্থানীয় বিধায়ক রণজিৎ মণ্ডল বলেন, “এখানে শান্তিপূর্ণ ভাবেই ভোট হয়েছে। এলাকার উন্নয়ন হয়েছে। তাই মানুষ আমাদের সঙ্গে আছে। ৩৪ বছর ধরে বামেরা সন্ত্রাস করেছে বলেই এ বার আর প্রার্থী পায়নি। নিজেদের কৃতকর্মের ফলকে চাপা দিতে ওরা সন্ত্রাসের মিথ্যে অভিযোগ করছে।” |
|
|
|
|
|