|
|
|
|
হামলার প্রতিবাদে বঁটি হাতে মহিলারা
পীযূষ নন্দী • আরামবাগ |
কারও হাতে বঁটি, কারও কাটারি, কারও লাঠিই সম্বল। কেউ আবার হাতের সামনে পাওয়া চেলা কাঠের টুকরোটা নিয়েই বেরিয়ে পড়েছেন। আঁচল গোঁজা কোমরে। উস্কোখুস্কো চুল, কারও আলুথালু শাড়ি। ‘ধর ধর’ করে তেড়ে যাচ্ছেন কখনও। লুঙ্গি গুটিয়ে পালানোর পথ পায় না বিরোধী পক্ষ। কেন্দ্রীয় বাহিনী, পুলিশের লাঠির সামনেও বেপরোয়া বাড়ির এই সব মেয়ে-বউরা। পুলিশের লাঠির ঘা খেয়ে যন্ত্রণায় মুখ বেঁকিয়ে ফের বঁটি উঁচিয়ে ছুটছেন।
সোমবার পঞ্চায়েত ভোটে মহিলাদের এই রুদ্রমূর্তি দেখল আরামবাগের সালেপুর। সকলেই সিপিআই কর্মী-সমর্থক পরিবারের। তৃণমূলের হামলার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে পড়েন তাঁরা। দিনের শেষে অবশ্য তাতে বিশেষ লাভ হয়নি। সালেপুরের রামনগর অবিনাশ হাইস্কুল ও পূর্ব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে সিপিআই প্রার্থীদের দুই এজেন্টকে সকাল ১০টার পর থেকে আর দেখা যায়নি। তৃণমূলই তাঁদের ঢুকতে দেয়নি বলে অভিযোগ। এক এজেন্টকে তুলে নিয়ে গিয়ে মারধরও করা হয়। বস্তুত, গোটা আরামবাগ মহকুমা জুড়েই বিভিন্ন বুথে বিরোধী প্রার্থীর এজেন্টরা বসতে পারেননি বলে অভিযোগ উঠেছে। কোথাও কাউকে চড়-থাপ্পর মেরে, কোথাও আবার স্রেফ চমকিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় বাহিনী, পুলিশের সঙ্গে কার্যত লুকোচুরি চলেছে হামলাকারীদের। রাস্তার মোড়ে মোড়ে, বুথের কিছুটা দূরে তৃণমূলের লোকজন জায়গায় জায়গায় মোতায়েন ছিল সকাল থেকে। তৃণমূল বিধায়ক কৃষ্ণচন্দ্র সাঁতরা অবশ্য বলেন, “ভোটারদের প্রভাবিত করতে চাইছিল। জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বাধা দিয়েছে। আমাদের কেউ কোনও ঝামেলা করেনি। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনেই ভোট হয়েছে।” |
|
পথে এ বার নামো...। সালেপুরে ছবিটি তুলেছেন মোহন দাস। |
সকাল পৌনে ৭টা নাগাদ রামনগর অবিনাশ হাইস্কুলের বুথে ঢুকতে গিয়েছিলেন সিপিএআই প্রার্থীদের এজেন্ট গোলকপতি পাড়ুই। অভিযোগ, তাঁকে মারধর করে বুথে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। খবর শুনেই আশপাশের বেশ কিছু সিপিআই কর্মী-সমর্থক পরিবারের মহিলারা বেরিয়ে পড়েন। বঁটি-লাঠি নিয়ে তাঁদের প্রতিবাদের সামনে তখনকার মতো পিছু হঠে তৃণমূলের লোকজন। পুলিশ-কেন্দ্রীয় বাহিনীও চলে আসে। আরামবাগের এই একটি মাত্র পঞ্চায়েত (সালেপুর ১) দীর্ঘ দিন ধরেই সিপিআইয়ের দখলে। তৃণমূলের সঙ্গে তো বটেই, শরিক দল সিপিএমের সঙ্গেও নানা সময়ে টক্কর নিয়ে এখানে ক্ষমতা ধরে রেখেছিল সিপিআই।
তবে এ দিন সিপিআই পুরুষ কর্মী-সমর্থকদের সামনের সারিতে বিশেষ দেখা যায়নি। উত্তেজনা ফের ছড়ায় সকাল ১০টা নাগাদ। গোলকপতিকে বুথের ভিতরে ঢুকেই মারতে মারতে তুলে নিয়ে যায় তৃণমূলের কিছু লোক। সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন থাকলেও সে সময়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরা কেউ ছিলেন না ওই বুথে। গোলকপতিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়তেই ফের হইহই করে বেরিয়ে পড়ে প্রমিলা বাহিনী। খবর পেয়ে আসেন জওয়ানেরাও। তাঁদের সঙ্গে বচসা বাধে মহিলাদের। কেন প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে না, সেই প্রশ্ন তুলে খেপে ওঠেন মহিলারা।
গোলকবাবুর দাদা রঘুপতি বাড়ুই সিপিআইয়ের জেলা কমিটির সদস্য। ভোটে এজেন্ট হয়েছেন। নিজে সালেপুর ১ পঞ্চায়েতের প্রার্থীও বটে। পূর্ব প্রাথমিক স্কুলের বুথ থেকে রঘুপতিবাবুকে সকাল ১০টা নাগাদ বের করে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। এই ঘটনায় আগুনে ঘি পড়ে। মহিলা ক্ষিপ্ত হয়ে জানিয়ে দেন, গোলককে যত ক্ষণ না ফিরিয়ে আনা হচ্ছে তত ক্ষণ ভোট বন্ধ রাখা হোক রামনগর অবিনাশ হাইস্কুলের বুথে। সেই দাবি অবশ্য ধোঁপে টেঁকেনি। উল্টে ভোটদানে বাধা, বুথে হামলা, পুলিশকে হেনস্থা করার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় গোলকের দিদি কল্পনা পাল, নমিতা দলুই-সহ ৪ জনকে।
কল্পনা বলেন, “বাড়ির পুরুষ মানুষরা কেউ বেরোতে সাহস পাচ্ছেন না। তাই আমরা জনা কুড়ি মেয়েই প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নেমে পড়ি। পুলিশ-কেন্দ্রীয় বাহিনী কিছুই করছে না। সারা ক্ষণ বুথে থাকার কথা। অথচ গোলমাল না হলে ওঁদের দেখাই মিলছে না। এই সুযোগে তৃণমূল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে এ সব দেখে আমরা আর চুপ করে বসে থাকতে পারিনি।” সবিতা মেদ্দা, নমিতা দলুইরা বলেন, “আমাদের পুলিশ মারল, তৃণমূলও মারল। এই অত্যাচার আর কত দিন সহ্য করা যায়। ভোটের আগে থেকেই তো এ সব সহ্য করতে হচ্ছে।” রঘুপতিবাবু বলেন, “তৃণমূল সারা দিন যা করল, তা সকলেই দেখেছেন। এ ভাবে সন্ত্রাস করেই ভোটে জিততে চায় ওরা।” ঘণ্টা খানেক পরে গোলকবাবু বাড়ি ফেরেন। চোখ-মুখ তখনও ফোলা। মারধরের চিহ্ন স্পষ্ট। গোলক জানালেন, তৃণমূলের ছেলেরা মারতে মারতে তাঁকে পাশেই দ্বারকেশ্বর নদী বাঁধের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। হুমকি দেওয়া হয়, আর যেন বুথমুখো না হন। স্বভাবতই, গোলক আর যাননি বুথে। তাঁর দাদাও বাড়িতেই কাটিয়েছেন বাকি দিনটা।
|
|
|
|
|
|