প্রবন্ধ...
চিন আছে, তাই দক্ষিণ আমেরিকা নির্ভয়
ফিদেল কাস্ত্রো সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসৃত। ক্যান্সার কেড়ে নিয়েছে উগো চাভেসকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে লাতিন আমেরিকার ‘ঠাণ্ডা লড়াই’ একই রকম আছে। যদি কিছু বদলায়, তা এইটুকু— কোনও এক জন নেতা নন, একই সঙ্গে বেশ কয়েক জন লাতিন আমেরিকান রাষ্ট্রপ্রধান দাঁড়িয়ে আছেন লড়াইয়ের প্রথম সারিতে ইকুয়েডরের রাফায়েল করিয়া, বলিভিয়ার ইভো মোরালেস, নিকারাগুয়ার ড্যানিয়েল ওর্তেগা, ভেনেজুয়েলার নিকোলাস মাদুরো। লাতিন আমেরিকার রাজনীতির এক বড় অক্ষ এখনও মার্কিন-বিদ্বেষ। এডওয়ার্ড স্নোডেন-কে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া নিয়ে সেই দ্বন্দ্ব ফের নতুন করে তীব্র হল। বস্তুত, ভেনেজুয়েলা বা কিউবার মতো যে দেশগুলোর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ক্রমে চলনসই হচ্ছিল, স্নোডেন-পর্ব তার অনেকটাই এলোমেলো করে দিয়ে গেল।
কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে লাতিন আমেরিকার সম্পর্ক চির কালই তিক্ত? যে কোনও রাষ্ট্রেরই একটি ‘অপর’ প্রয়োজন হয়, বিশেষত যে রাষ্ট্রের পরিচালকরা জোর দিতে চান জাতীয়তাবাদের ওপর। লাতিন আমেরিকার সমাজতন্ত্রী দেশগুলোর সেই ‘অপর’ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই কেন? কারণ, সে দেশটি নিজেকে গোটা দুনিয়ারই বড়দা মনে করেু— আফগানিস্তান বা ইরাকেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নিয়েও যেমন তার উদ্বেগের অন্ত নেই। একেবারে ঘরের কাছের লাতিন আমেরিকার ওপর এই বড়দাগিরির প্রভাব স্বভাবতই সবচেয়ে বেশি পড়েু— ওবামা-প্রশাসনের সেক্রেটারি অব স্টেট জন কেরি কিছু দিন আগেই লাতিন আমেরিকাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ব্যাকইয়ার্ড’ বলেছিলেন। মন্তব্যটি তাঁর, কিন্তু মানসিকতাটি প্রায় দুশো বছর পুরনো। ১৮২৩ সালে, আমেরিকা একটা নীতি তৈরি করেছিলু— মনরো ডকট্রিন। তার মূল কথা ছিল, উত্তর বা সদ্য ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত দক্ষিণ আমেরিকাকে যদি কোনও ইউরোপীয় শক্তি ফের দখল করতে চায়, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয় ভাবে বাধা দেবে। গত শতকের শুরুতে প্রেসিডেন্ট থিয়ডর রুসভেল্ট এই ডকট্রিনে জুড়ে দিলেন আরও কিছু কথা— লাতিন আমেরিকার কোনও দেশ যদি ভুল পথে চালিত হয়, তবে তাকে শাসন করার অধিকারও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থাকবে। এই আইন-বাঁধা দাদাগিরি থেকেই লাতিন আমেরিকায় মার্কিন বিরোধী রাজনীতির সূত্রপাত।

সহযোদ্ধা। ‘অপমানিত’ মোরালেসের সমর্থনে সমবেত লাতিন আমেরিকান রাষ্ট্রপ্রধানরা।
(বাঁ দিক থেকে) ইকোয়েডরের রাফায়েল করিয়া, উরুগুয়ের হোসে মুহিকা, আর্জেন্টিনার
ক্রিস্তিনা ফের্নান্দেস দে কার্শনার, বলিভিয়ার এভো মোরালেস, ভেনেজুয়েলার
নিকোলাস মাদুরো। কোচাকাম্বা, বলিভিয়া, ৪ জুলাই, ২০১৩। ছবি: এ পি
স্বভাবতই খটাখটি লেগেছে সমাজতন্ত্রী দুনিয়ার সঙ্গে। কিউবায় কাস্ত্রো ক্ষমতা দখল করার পর সি আই এ-র গোপন নথিতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল, ‘গোট মহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে যে কাস্ত্রো-ইজম, তা কিউবার প্রতিপত্তির কারণে নয়... কিউবার ছায়া দীর্ঘতর হচ্ছে, কারণ মহাদেশের আর্থিক এবং সামাজিক অসাম্য বর্তমান শাসকদের বিরুদ্ধে মানুষকে খেপিয়ে তুলেছে এবং বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য তৈরি করছে।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজতন্ত্র-ভীতি প্রবল। ফলে যে কোনও ভাবেই হোক, লাতিন আমেরিকার ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে মরিয়া মার্কিন প্রশাসনু— রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট, উভয়েই। তার জন্য গত ষাট বছরে অনেক কিছুই করেছে আমেরিকা— বেশ কয়েকটা সামরিক অভ্যুত্থানে মদত দিয়েছে, গোটা দুনিয়ার বিরুদ্ধে গিয়ে সামরিক শাসনকে ‘গণতন্ত্র’-র স্বীকৃতি দিয়েছে, গোটা মহাদেশ জুড়ে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করেছে, এবং ‘ড্রাগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করে কার্যত সব দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর প্রবল চেষ্টা করেছে। তার প্রত্যাশিত ফলই হয়েছে সমাজতন্ত্রী লাতিন আমেরিকার নেতারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে গাল না পেড়ে বক্তৃতা শুরু এবং শেষ করেছেন, এমন নজির নেই।
তবু, লাতিন আমেরিকায় সব দেশই যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু ছিল, তা নয়। মেক্সিকো, কলম্বিয়া, ব্রাজিলের মতো দেশ, এমনকী ঘোর মার্কিন বিরোধী ইকুয়েডরও, বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বিশেষ ভাবে নির্ভরশীল। তীব্র খারাপ থেকে সম্পর্ক ক্রমে চলনসই গোছের হচ্ছিল ভেনেজুয়েলা, কিউবার মতো দেশের সঙ্গেও। কিন্তু ফের সব গোলমাল হয়ে গেল এডওয়ার্ড স্নোডেনের প্রশ্নে। তাঁকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার প্রশ্নেও বটে, কিন্তু এখন তার চেয়েও বড় প্রশ্ন তৈরি করেছে তাঁর ফাঁস করে দেওয়া তথু্য— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লাতিন আমেরিকার সব দেশের ওপর নজরদারি চালাত। চিরশত্রু দেশগুলো তো বটেই, ব্রাজিল বা মেক্সিকোর মতে দেশের ওপরেও। এই কথাটি স্বভাবতই এই দেশগুলোর পক্ষে হজম করা কঠিন। নিজেদের দেশে মার্কিন খবরদারি তাদের চিরকালীন ক্ষোভের কারণ। যে ভাবে লাতিন আমেরিকায় একের পর এক মার্কিন সামরিক ঘাঁটি তৈরি হয়েছে, যে ভাবে ‘ড্রাগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ লড়তে গিয়ে সব দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে চেয়েছে আমেরিকা— সেই সব জমে থাকা ক্ষোভ ফের মাথাচাড়া দিয়েছে এখন। স্পষ্টই বলা হচ্ছে, আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে নিজের সমান ভাবে না— তারা সাম্রাজ্য বিস্তার করতে চায়, এখনও।
তারই মধ্যে মস্কো থেকে ফেরার পথে বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস-এর ব্যক্তিগত বিমানকে নিজেদের আকাশসীমায় ঢুকতে দিতে অস্বীকার করল চারটি ইউরোপীয় দেশু— ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল এবং ইতালি। তাদের কাছে নাকি খবর ছিল, মোরালেসের বিমানেই এডওয়ার্ড স্নোডেন আছেন। এই ঘটনাতেও বিস্তর চটেছেন লাতিন আমেরিকান নেতারা। চটার মতোই ঘটনা— আন্তর্জাতিক প্রোটোকল অনুযায়ী, কোনও দেশের গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে নিজের আকাশসীমায় ঢুকতে দিতে অস্বীকার করতে পারে না কোনও দেশ। এটা প্রবল অশিষ্টাচার।
বস্তুত, মোরালেস-কাণ্ডই লাতিন আমেরিকার দেশগুলিকে এক মার্কিন-বিরোধী মঞ্চে নিয়ে এসেছে। তিনটি দেশু— বলিভিয়া, নিকারাগুয়া এবং ভেনেজুয়েলা— স্নোডেনকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। ইকুয়েডর জানিয়েছে, স্নোডেন ফের আবেদন করলে তারা ‘সহানুভূতির সঙ্গে’ বিবেচনা করবে। কিন্তু, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বড় ধাক্কা হল, কলম্বিয়া বা মেক্সিকোর মতো ‘বন্ধু’ দেশগুলোও এই প্রশ্নে তাদের বিরুদ্ধে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে বা উরুগুয়ের মতো মধ্যপন্থী দেশগুলো বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, যে কোনও ব্যক্তিকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার সর্বভৌম অধিকার সব দেশের আছে অর্থাৎ, তারাও আমেরিকার সঙ্গে নেই।
প্রশ্ন হল, এত জোর গলায় মার্কিন-বিরোধী অবস্থান নেওয়ার সাহস এই দেশগুলোর হয় কী করে? সবার ওপরে অর্থনীতি সত্য, এটা ভুললে চলবে না। লাতিন আমেরিকার মার্কিন-বিরোধী রাজনীতির অর্থনীতির মডেল ক্রমে বদলেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের জমানায় কিউবার বাণিজ্য ছিল সে দেশের সঙ্গে সেটা সমাজতন্ত্রী দুনিয়ার বিরাদরির গল্প। আজকের দুনিয়ায় সেই গল্প অচল। চাভেস, তাঁর বিপুল তেলের ভাণ্ডারের দৌলতে, অন্য একটা রাস্তা তৈরি করেছিলেন। তিনি কিউবাকে তেল দিতেন, বদলে কিউবার থেকে সামাজিক পরিকাঠামো তৈরির মদত পেতেন। শুধু কিউবাই নয়, গোটা ক্যারিবিয়ন দ্বীপপুঞ্জ জুড়ে সস্তায় তেল দিয়েছিলেন চাভেস, বদলে পেয়েছিলেন রাজনৈতিক সমর্থন। তাঁর মডেলটি সমাজতন্ত্রী লাতিন আমেরিকায় বেশ জনপ্রিয়। ইকুয়েডর এবং বলিভিয়া, উভয় দেশই হেঁটেছে তাঁর দেখানো পথে।
কিন্তু, আসল খেলাটা বদলে দিয়েছে চিন। গোটা লাতিন আমেরিকার সঙ্গেই চিনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্রমে বাড়ছে। খনিজ তেল থেকে কৃষিজাত পণ্য, চিনের বাজারের দরজা লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর জন্য খোলা। ব্রাজিল, পেরু, চিলি থেকে ইকুয়েডর, সব দেশই কম-বেশি চিনের সঙ্গে বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়াচ্ছে। অন্য দিকে, চিন বিভিন্ন প্রয়োজনে ঋণও দিচ্ছে। বস্তুত, চিনের অর্থনৈতিক মহাশক্তি হিসেবে উত্থান অনেক দিন পর গোটা দুনিয়াকে আবার দ্বিমেরু করেছে। লাতিন আমেরিকার মার্কিন বিরোধী দেশগুলো, স্বভাবতই, চিনের মেরুর কাছাকাছি চলে আসছে। তাদের মার্কিন-বিরোধিতা দাঁড়িয়ে আছে চিনের শক্তির গায়ে ভর করে, অন্তত অনেকাংশে।
ইকুয়েডরের কথাই ধরা যাক। এমনিতে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইকুয়েডর বেশ ভাল রকম নির্ভর করে আমেরিকার ওপর। গত বছর সে দেশের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৬০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি। তার অর্ধেক বাণিজ্যই ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। এই বাণিজ্যের পথে একটি বড় সহায় ছিল অ্যান্ডিয়ান ট্রেড প্রোমোশন অ্যান্ড ড্রাগ ইর্যাডিকেশন অ্যাক্ট। এই চুক্তির ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানি করার সময় কম শুল্ক দিতে হত, আমদানি করার সময়ও কম খরচ হত। স্নোডেন ইকুয়েডরের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করার পরই আমেরিকার রাজনীতিবিদদের একটি অংশ, বিশেষত রক্ষণশীলরা, বলতে আরম্ভ করেন, তা হলে এই চুক্তি আর নবীকরণ করা হবে না। স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক কর্তা স্পষ্টই বলেন, স্নোডেনকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিলে ইকুয়েডর আর্থিক ঝামেলায় পড়বে। তার প্রতিক্রিয়া হল মারাত্মক। রাফায়েল করিয়া এক বিস্ফোরক বিবৃতি দিলেন। বললেন, আমাদের ওপর চাপ তৈরি করে লাভ হবে না। আমি এখনই ঘোষণা করে দিচ্ছি যে ওই চুক্তির পুনর্নবীকরণ আমি মানব না। দরকার নেই মার্কিন বদান্যতার।
বহুমুখী চাপে গত দশ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ নীতি বদলে গেছে বহু ভাবে। সেই চাপের একটা অনস্বীকার্য অংশের নাম চিন। এখন দেখার, সেই চিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে লাতিন আমেরিকার সম্পর্কের রূপরেখাটি কী ভাবে বদলে দিতে পারে, বা আদৌ পারে কি না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.