কথায় নয়। কাজে করে দেখালেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্ণধার ডি সুব্বারাও।
সোমবার নর্থ ব্লকে অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের পরই ডলারের সাপেক্ষে টাকার দরে পতনে বাঁধ দিতে তিন দাওয়াই ঘোষণা করল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক
(১) বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে দীর্ঘ মেয়াদে দেওয়া ঋণে সুদের হার (ব্যাঙ্ক রেট) বাড়িয়ে ১০.২৫% করা।
(২) বাড়িয়ে ১০.২৫% করা হল মার্জিনাল স্ট্যান্ডিং ফেসিলিটি-ও (এমএসএফ)। নগদে টান পড়লে, সেই আপৎকালীন পরিস্থিতিতে এই সুদেই শীর্ষ ব্যাঙ্কের কাছে ধার নেয় ব্যাঙ্কগুলি।
(৩) আগামী ১৮ জুলাই সরকারি ঋণপত্র বিক্রি করে বাজার থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে দিল তারা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই তিন অস্ত্র ব্যবহারের ফলে ব্যাঙ্কের নগদ সংগ্রহের খরচ বাড়বে। টাকার জোগান কমবে বাজারে। ফলে অর্থনীতির নিয়ম মেনে দাম বাড়বে তার। আর টাকার দাম বাড়লে ডলারের সাপেক্ষে তার দরও চড়তে শুরু করবে বলে আশা করছেন তাঁরা। তবে রেপো রেট অপরিবর্তিত থাকায় এখনই গাড়ি-বাড়ি ঋণে সুদ বদলের সম্ভাবনা কম বলেই বিশেষজ্ঞদের দাবি।
আগামী ৩০ জুলাইয়ের ঋণনীতির অপেক্ষা না-করে এ দিন গভীর রাতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তড়িঘড়ি এমন ঘোষণা করায়, অবাক হয়েছেন অনেকেই। কারণ, সন্ধ্যা নাগাদও তাঁদের মনে হয়েছিল বৈঠক নিষ্ফলা। সুদ কমানোর তেমন প্রতিশ্রুতি আর কোথায় দিলেন সুব্বারাও? কোথায়ই বা টাকার দর চাঙ্গা করার পদক্ষেপ? কিন্তু রাতে শীর্ষ ব্যাঙ্ক তিন ঘোষণা করতেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এ দিন আলোচনার তার কোন সুরে বাঁধা ছিল। |
মার্কিন মুলুক থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পরই এ দিন সুব্বারাওয়ের সঙ্গে বৈঠকে বসেন চিদম্বরম। এই আলোচনার জন্যই শীর্ষ ব্যাঙ্কের কর্ণধারকে মুম্বই থেকে তাড়াতাড়ি আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি। সুব্বারাওয়ের সঙ্গে আলাদা-আলাদা ভাবে কথা বলেন অর্থ মন্ত্রকের মুখ্য উপদেষ্টা রঘুরাম রাজন, অর্থ বিষয়ক সচিব অরবিন্দ মায়ারাম, অতিরিক্ত সচিব কে পি কৃষ্ণনও। কিন্তু ঘণ্টা দু’য়েকের বৈঠক শেষে টাকার দর চাঙ্গা করা নিয়ে সাংবাদিকদের সামনে মুখ খোলেননি সুব্বারাও। দেননি গাড়ি-বাড়ি ঋণের সুদ কমানোর পথ প্রশস্ত করার প্রতিশ্রুতিও। বরং বলেন, “ঋণনীতি ঘোষণার সময় মূল্যবৃদ্ধির হার অবশ্যই মাথায় থাকবে।”
এমনিতে এই বিবৃতি নিছকই আমলাসুলভ কেঠো সরকারি বয়ান। কিন্তু মুশকিল হল, এ দিন প্রকাশিত সরকারি পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট যে, মাঝে কিছুটা নামার পর ফের মাথা তুলছে মূল্যবৃদ্ধির দৈত্য। মে মাসের ৪.৭% থেকে বেড়ে জুনে তা পৌঁছেছে ৪.৮৬ শতাংশে। স্রেফ সংখ্যার বিচারে এই বৃদ্ধি তেমন বেশি নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সিঁদুরে মেঘ দেখছিল কেন্দ্র। কারণ, তারা মনে করছিল, মূল্যবৃদ্ধি ফের মাথাচাড়া দেওয়ার এই প্রবণতাই বাধা হয়ে দাঁড়াবে রেপো রেট (বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি শীর্ষ ব্যাঙ্কের কাছে যে সুদে ধার নেয়) কমানোর পথে।
আশঙ্কায় ঘি ঢালে পেঁয়াজ, চাল ও খাদশস্যের দাম বাড়ার ধাক্কা। দেখা যাচ্ছে, পেঁয়াজের দামই বেড়েছে ১১৪%। অনেকেই মনে করছিলেন, চিদম্বরম থেকে রঘুরাম রাজনখাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার এই পরিসংখ্যান সকলের ঘুম কাড়ার পক্ষেই যথেষ্ট। তাঁদের যুক্তি, ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম এমনিতেই তলানিতে (এ দিন পড়েছে ৩৩ পয়সা)। ফলে চড়চড়িয়ে বাড়ছে তেল-গ্যাস-যন্ত্রাংশ আমদানির খরচ। যার জেরে আগামী দিনে মূল্যবৃদ্ধির ভুত ফের ঘাড়ে চড়তে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। তার উপর এ বার খাদ্যপণ্যের দামের সূচকও উপর দিকে হাঁটা দিলে, তারা সুদ কমানোর ঝুঁকি আদৌ নেবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহের মেঘ গাঢ় হচ্ছে বলে মত দিচ্ছিলেন অনেকে।
কিন্তু দিনের শেষে গাড়ি-বাড়ি-ব্যক্তিগত প্রয়োজনে নেওয়া ঋণে সুদ কমানো নিয়ে মুখ না-খুললেও, টাকার দর চাঙ্গা করার বিষয়ে একেবারে ত্রিমুখী পদক্ষেপ ঘোষণা করে দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। মার্কিন শীর্ষ ব্যাঙ্কের কর্তা বেন বার্নানকে আপাতত ত্রাণ প্রকল্প চালু রাখার আশ্বাস দেওয়ায় সম্প্রতি কিছুটা হলেও হালে পানি পেয়েছিল টাকা। কিন্তু এ দিন ফের ৩৩ পয়সা পতন রক্তচাপ বাড়িয়েছে কেন্দ্রের। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এই রাস্তায় না-হাঁটলে, বন্ড ছেড়ে ডলার পাওয়া ছাড়া তেমন পথ খোলা থাকত না বলে মনে করছেন অর্থ মন্ত্রকের কর্তারাই। |