এক সময় সিপিএমের লালদুর্গ হিসেবে পরিচিত ময়ূরেশ্বরের ঢেকা পঞ্চায়েত এলাকায় জোট ভেঙে গিয়েছিল শরিক দলগুলির সঙ্গে। গতবার বিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সিপিএমকে ধরাশায়ী করেছিল ফরওয়ার্ড ব্লক। তবে এ বার শাসকদল তৃণমূলকে হারাতে সিপিএম ও ফব এক সঙ্গে নামছে। তৃণমূল অবশ্য এই জোটকে খুব এতটা গুরুত্ব দিতে রাজি নয়। সব মিলিয়ে রাজনৈতিক এই চাপানউতোরে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে প্রত্যন্ত এলাকাটি।
সংশ্লিষ্ট ময়ূরেশ্বর ২ ব্লকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ‘ব্লু প্রিন্ট’ তৈরি হতো ঢেকায় পঞ্চায়েত এলাকায়। নির্বাচন শুরু হওয়ার পর থেকে ২০০৮ সাল ছাড়া মাঝে একবারই মাত্র বিরোধীরা ওই পঞ্চায়েতের ক্ষমতা দখল করতে পারে। ২০০৮ সালের আগে সিপিএম ছাড়া ফ্রন্টের অন্য কোনও শরিকের কার্যত অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে। ওই ভোটের আগে কিছু বিক্ষুব্ধ এবং বহিষ্কৃত সিপিএম কর্মী-সমর্থকের হাত ধরে ফব’র আত্মপ্রকাশ ঘটে। সেবার তারা তৃণমূল-বিজেপি এবং কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে সিপিএমের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াইয়ে নামে। বারোটি আসনের মধ্যে ফব ৩, বিজেপি ২, তৃণমূল ২ এবং বাকি পাঁচটি আসন সিপিএম দখল করে। ফব-র কল্যাণী দাসকে প্রধান এবং তৃণমূলের অরুণ গড়াইকে উপপ্রধান করে বোর্ড করে সিপিএম বিরোধী জোট।
এ বারে অবশ্য সেই জোট ভেঙে গিয়েছে। সিপিএমের সঙ্গে গাঁটছাড়া বেঁধেছে ফব। পঞ্চায়েতের ১৪টি আসনের মধ্যে তারা লড়ছে চারটিতে। বাকিগুলিতে প্রার্থী দিয়েছে সিপিএম। অন্য দিকে, দক্ষিণ পন্থীদের মধ্যে কোনও জোট হইনি। তৃণমূল একক ভাবে ১৪টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। আলাদা ভাবে কংগ্রেস চারটি এবং বিজেপি ৮টি আসনে লড়ছে। পঞ্চায়েত সমিতির তিনটি আসনে সিপিএম, তৃণমূল এবং বিজেপি তিনটি করে প্রার্থী দিলেও কংগ্রেসের প্রার্থী রয়েছে দু’টি আসনে। জেলা পরিষদের একটি আসনে সিপিএম, বিজেপি এবং তৃণমূল প্রার্থী থাকলেও কংগ্রেসের কেউ নেই। লড়াইয়ের ময়দানে এ বারে জোট না হওয়ায় তৃণমূলে যেমন কিছুটা দুশ্চিন্তা রয়েছে, তেমনই জোট করেও স্বস্তিতে নেই ফ্রন্ট। কারণ, মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় সিপিএম-ফব পরস্পরের বিরুদ্ধে বেশ কিছু আসনে গোঁজ প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল। পরে অবশ্য ‘উপরতলার’ নেতাদের চাপে গোঁজ প্রার্থীদের প্রত্যাহার করা হলেও, উভয় দলের বিক্ষুব্ধ কর্মী সমর্থকদের একাংশ একে অন্যকে মেনে নিতে পারছেন না। তাঁদের কেউ কেউ শরিক দলের প্রার্থীদের বদলে তৃণমূলকে ভোট দেবেন কিংবা ভোটদানে বিরত থাকবেন বলেই রাজনৈতিক মহলের অভিমত।
এই সম্ভাবনার কথা উডিয়ে দিছেন না ফব’র ময়ূরেশ্বর ২ ব্লক সভাপতি জোনাব শেখও। তিনি বলেন, “আসন সমঝোতা হলেও সিপিএম আমাদের হারানোর জন্য প্রথমে গোঁজ প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল। আমরাও তাই পাল্টা গোঁজ প্রার্থী দিয়েছিলাম। দু’পক্ষের মধ্যস্থতায় গোঁজ প্রার্থীদের প্রত্যাহার করা হলেও, অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা রয়েইছে।” সিপিএমের ময়ূরেশ্বর জোনাল কমিটি সম্পাদক অরুপ বাগ অবশ্য দাবি করেন, “অন্তর্ঘাতের কোনও আশঙ্কাই নেই। দলের সমস্ত স্তরের কর্মীদের নিয়েই সার্বিক ঐক্যের লক্ষ্যে জোট করা হয়েছে। এর পরে কেউ যদি উল্টো পথে হাঁটেন, তা হলে ফ্রন্টগত সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।”
ফ্রন্ট শরিকদের এই দোলাচলের পাশাপাশি তৃণমূলকে উজ্জিবিত করেছে গত বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল। ওই নির্বাচনে সিপিএম, বিজেপি প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ত্রিমুখী লড়াইয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে আসরে নামেন তৃণমূল প্রার্থী। সেই নির্বাচনে ওয়ার্ড ভিত্তিক ফলাফলের নিরিখে পঞ্চায়েতের ১৪টি আসনের মধ্যে ৭টিতে এগিয়েছিল তৃণমূল জোট। অন্য একটিতে জয়ী সিপিএম প্রার্থীর সমান ভোট পেয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী। এগিয়ে থাকা সাতটি ওয়ার্ডের মধ্যে এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রার্থী রয়েছে তিনটি জায়গায়। সেই হিসেবে চারটি ওয়ার্ডে বিধানসভার প্রাপ্য ভোট ধরে রাখতে পারলেই তাদের জয়ের সম্ভাবনা প্রবল। অন্য দিকে, তিলডাঙা, নবগ্রাম, রসুনপুর, কুলিয়াড়ার মতো সিপিএম তথা বাম বিরোধী এলাকা হিসাবে পরিচিত চারটি ওয়ার্ড-সহ মোট ছয়টি ওয়ার্ডে প্রার্থী দিতে পারেনি বিজেপিও। তিলড়াঙা ছাড়া বাকি পাঁচটি আসনে কংগ্রেসেরও কোনও প্রার্থী নেই। বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে সম অবস্থানে থাকা কুমারপুর সংসদেও প্রার্থী নেই কংগ্রেসের। সেই হিসেবে বাম বিরোধী ভোট ভাগাভাগি হওয়ার সম্ভাবনা কম। সেই অঙ্কে পঞ্চায়েত দখলের ব্যাপারে অনেকখানি নিশ্চিত তৃণমূল।
তৃণমূলের অঞ্চল কমিটির সভাপতি সুশান্ত পাল বলেন, “ফব-সহ অন্যান্য দলের সঙ্গে বোর্ড চালাতে গিয়ে স্বাধীন ভাবে কোনও কাজ করতে পারিনি। পঞ্চায়েত টিকিয়ে রাখার বাধ্য বাধকতায় ফব’র কথা মতো চলতে হয়েছে।” তাঁর দাবি, “এলাকার মানুষ তা দেখেছেন একদলীয় পঞ্চায়েত ব্যাবস্থা না হলে স্বাধীন ভাবে সমহারে উন্নয়ন করা যায় না। আমরা ছাড়া কোনও দলই একক ভাবে পঞ্চায়েত দখলের মতো প্রয়োজনীয় প্রার্থী জেতানোর অবস্থানে নেই। ফব, সিপিএম-সহ অন্যান্য দল থেকেও বহু নেতাকর্মী আমাদের দলে যোগ দিয়েছেন। সেই হিসেবে পঞ্চায়েতে এ বার একক ভাবেই ঘাসফুল ফুটবে।” তবে তৃণমূলের ঘাসফুল ফুটবে না কি বামেদের আধিপত্য কায়েম থাকবে তা অবশ্য সময় বলবে। |