আশঙ্কাটা ছিলই। এক গোষ্ঠীর প্রার্থী দেওয়া নিয়ে ফুঁসছিল তৃণমূলের আর এক গোষ্ঠী। বিস্ফোরণটা ঘটল ভোটের দিন সকালে।
মঙ্গলকোটে বোমায় নিহত শাহিদুল্লা মল্লিক ওরফে কটা যে তৃণমূলের কর্মী, সে সম্পর্কে পুলিশের কোনও সন্দেহ নেই। প্রশ্ন ছিল, বোমা কারা মারল? যে ভাবে মৃতদেহের পাশে অ্যালুমিনিয়ামের বালতির টুকরো ছড়িয়ে পড়ে আছে আর মাটিতে একাধিক বোমা ফাটার দাগ, পুলিশের অনুমান, তিনিই বালতিতে বোমা নিয়ে যাচ্ছিলেন। হুমড়ি খেয়ে পড়ায় সেগুলি ফেটে যায়।
বস্তুত, বারুদের স্তুপের উপরে বসে আছে মঙ্গলকোটের পূর্ব নওয়াপাড়া গ্রামটাই। সেখানেই পশ্চিমপাড়ায় শাহিদুল্লার বাড়ি। যদিও তিনি এমনিতে বর্ধমান শহরেই শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। ভোটের জন্য বাড়ি এসেছিলেন। সোমবার দুপুরে গ্রামের বাগানেপাড়ার কাছে খেতজমি থেকে তাঁর দেহ পুলিশ উদ্ধার করে। বর্ধমানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গ্রামীণ) তরুণ হালদার বলেন, “ওই ব্যক্তি বোমার আঘাতে মারা গিয়েছেন। আমরা পুরো বিষয়টি তদন্ত করছি।” মঙ্গলকোট থানা সূত্রে জানা গিয়েছে, মৃতদেহের পাশ থেকে জুতো, অ্যালুমিনিয়াম বালতির টুকরো এবং নাইন এম এম পিস্তলের কার্তুজ উদ্ধার করা হয়েছে। |
পূর্ব নওয়াপাড়ায় ছড়িয়ে রক্ত। ছবি: সৌমেন দত্ত। |
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, স্থানীয় ঝিলু ২ পঞ্চায়েতের ১১টি আসনের মধ্যে ৯টিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে। যার মধ্যে ৬টিতে বিক্ষুব্ধ তৃণমূল বা নির্দল প্রার্থীরা দাঁড়িয়েছেন। আর তিনটিতে দাঁড়িয়েছে সিপিএম। তৃণমূলের একটি সূত্র থেকে জানা গিয়েছে, ঝিলু ২ পঞ্চায়েতে তৃণমূলের নেতা (পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী) শেখ বাসেদ আলির সঙ্গে আর এক তৃণমূল নেতা কাশেম কাজির অনেক দিন ধরে গোলমাল। প্রার্থী দেওয়া নিয়েও অশান্তি হয় ওই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে। নির্দল প্রার্থীরা গোলমালের আশঙ্কায় নিরাপত্তা দাবি করে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের নানা স্তরে চিঠি দিয়েছিলেন।
আশঙ্কা সত্যি করেই এ দিন সকাল ১০টা নাগাদ দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, পূর্ব নওয়াপাড়া গ্রামের বুথ থেকে কিছুটা দূরে বাগানেপাড়া ও কাজিপাড়ার মাঝে খেতজমিতে সংঘর্ষ শুরু হয়। বাগানেপাড়ায় ছিলেন বাশেদ গোষ্ঠীর লোকজন। অন্য দিকে ছিল কাশেম কাজি গোষ্ঠীর লোকেরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক জন বলেন, ‘‘ভোট প্রথমে নির্বিঘ্নেই মিটছিল। বেলা ১০টা নাগাদ আচমকা বাশেদের লোকজন অ্যালুমিনিয়াম বালতিতে বোম নিয়ে কাজিপাড়ার দিকে আক্রমণ করে।” আক্রমণ আটকাতে কাশেম কাজি গোষ্ঠীর লোকজনও এগিয়ে আসে। আক্রমণ করে গোলাগুলি নিয়ে। সেই সময়ে পালাতে গিয়ে বোমায় মারা যান শাহিদুল্লা। প্রায় ঘণ্টাখানেক খেতজমিতে দেহ পড়ে থাকার পরে পুলিশ এসে ময়নাতদন্তের জন্য দেহ নিয়ে যায়। এ দিনই কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে দেহের ময়নাতদন্ত হয়।
দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, চাপ চাপ রক্তের দাগ। বারুদের গন্ধ এলাকা জুড়ে। একই জায়গায় বেশ কয়েকটি বোমা ফাটার চিহ্ন স্পষ্ট। আলপথের রাস্তায় নাইন এমএম পিস্তলের কার্তুজ পড়ে আছে। অ্যালুমিনিয়াম বালতির টুকরোও পড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। খুনের ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরে পুলিশ গিয়ে এই সব নমুনা সংগ্রহ করে। পুলিশের অনুমান, কাজিপাড়া থেকে আক্রমণ হওয়ার সময় বোমা ভর্তি অ্যালুমিনিয়াম বালতি নিয়ে পিছু হটছিলেন শাহিদুল্লা। সেই সময়ে পড়ে যেতেই বিস্ফোরণ হয়। তবে নিহতের মা মোসেহারা বিবি ও বাবা ইয়ার মহম্মদ মল্লিকের দাবি, “ছেলে-বউ বর্ধমানে থাকে। ছেলের বউ অসুস্থ। ভোটের জন্য ছেলে গ্রামে এসেছিল। আমরা তৃণমূল সমর্থক। সে কারণে ভোট দিয়ে ফেরার সময় বিরেধীরা বোমা মেরে খুন করল।”
প্রসঙ্গত, এক বছর আগে দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষের জেরে নিহতের দাদা লাল্টু মল্লিকও খুন হন। সেই সময় ১০০ দিনের কাজ নিয়ে বামেদের সঙ্গে কাশেম কাজি গোষ্ঠীর সংঘর্ষ হয়। ওই সময় বোমা মেরে লাল্টু মল্লিককে খুন করার অভিযোগ ওঠে কাশেম কাজি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। তৃণমূলের বর্ধমান জেলা (গ্রামীণ) সভাপতি স্বপন দেবনাথ অবশ্য দাবি করেন, “সিপিএম ও তাদের সমর্থিত নির্দল প্রার্থীরা এ দিন ওই গ্রামে বুথ দখল করার চেষ্টা করে। প্রতিবাদ করায় পিছন থেকে বোমা মেরে আমাদের কর্মীকে খুন করা হয়েছে।” যদিও এই অভিযোগ ‘হাস্যকর’ বলে উড়িয়ে দিয়ে সিপিএমের বর্ধমান জেলা কমিটির সদস্য অচিন্ত্য মল্লিক বলেন, “ওই গ্রামে আমাদের প্রার্থী নেই। প্রায় চার বছর ধরে আমরা রাজনৈতিক কাজকর্মও করতে পারছি না। এই খুন তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জন্যই হয়েছে।” |