প্রবন্ধ...
‘একার সঙ্গে মুখোমুখি হলো একা’
ক’দিন আগে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে তাদের আবাসনে ঢুকছি, গেটের প্রহরী আমাকে দাঁড় করিয়ে নাম-ঠিকানা লিখতে বললেন। বন্ধুর ফ্ল্যাটে ঢুকতেই তার প্রশ্ন: ‘সিকিয়োরিটি গার্ড কোনও অসভ্যতা করেনি তো?’ বললাম, ‘অসভ্যতা কেন হবে, প্রহরী তাঁর ডিউটি করেছেন, আমাকে দাঁড় করিয়ে নাম-ঠিকানা লিখিয়ে নিলেন।’ এ বারে বন্ধুটির রসিকতা: ‘থিয়েটারের স্টার বলে চিনতে পারেনি, রণবীর কপূর হলে ছেড়ে দিত।’
একমত হতে পারলাম না। রণবীর কপূরকেও কড়া প্রহরায় হাত তুলে দাঁড়াতে হয়, ভারতে যদি নাও-বা হয়, আমেরিকার কোনও বিমানবন্দরে তো বটেই। আমরা প্রত্যেকে যে পেশারই হই-না-কেন, যত উঁচুতেই উঠি-না-কেন, আমাদের কোথাও-না-কোথাও হাত তুলে দাঁড়াতেই হয়। এ কথাটাই আমাদের খেয়াল থাকে না দৌড়তে দৌড়তে। ঘোড়ার পিঠে চেপেছি তো আমরা, হুঁশ থাকে না কোথায় থামতে হবে। ভুলে যাই যে, যদি না থামতে চাই, নিজেদেরই ছোট্ট অথচ মারাত্মক কোনও ত্রুটিতে এক সময়ে ঠিক থেমে যেতে হয়। তখন হাত তুলেই দাঁড়াতে হয়, মাথা নোয়াতে হয় কোনও ব্যবস্থা বা রাষ্ট্রশক্তি, প্রতিষ্ঠান বা মিডিয়া-র রক্তচক্ষুর সামনে। নিজের কাছেই নিজেকে জবাবদিহি করতে হয়।
‘অলীক সুখ’-এর যে চরিত্রে আমি অভিনয় করেছি, তার ঠিক এমনই দশা! সে ডাক্তার, রীতিমত দায়িত্ববান, তার রোগীদের প্রতি, তার পরিবারেরও প্রতি। সে যেমন যত্ন করে রোগী দেখে, তেমনই যত্ন করে বাবা-মা-বউ-বাচ্চাকে। নিজের ডাক্তারির গুণেই সে ক্রমশ যশ-অর্থ পেতে শুরু করে। সেই পাওয়াটা বাড়তে-বাড়তে এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়ায়, ক্ষণিকের জন্যে হলেও সে তার কর্তব্যের বোধ থেকে সরে যায়। ফলে অপরিমেয় ক্ষতি তার রোগীর তো হয়ই, সমপরিমাণ ক্ষতি তার নিজেরও হয়। নিজের কাছেও সে খুব ছোট হয়ে যায়। তার মাস্টারমশাই, তিনিও ডাক্তার, তাকে বলেন মানুষের শরীর যে যন্ত্র নয়, এটা তুমি ভুলে গেলে কী করে?
যে সব ডাক্তার দিনে প্রচুর অপারেশন আর একগাদা চেম্বার করেন, ক্রমাগত এক নার্সিংহোম থেকে অন্য নার্সিংহোমে ছুটে বেড়ান, এ-ছবিতে তাঁদের সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠে এঁরা প্রত্যেক রোগীকে চার মিনিটের বেশি সময় দেন না, এঁরা রোগীর মন বুঝবেন না রোগ বুঝবেন?
কিন্তু এটা তো শুধু ডাক্তারি পেশার সমস্যা নয়, প্রতিটি পেশারই সমস্যা। এটা আদতে একটা মূল্যবোধের লড়াই কী ভাবে দেখব নিজের পেশাটাকে, নিজের জীবনটাকে? নিশ্চয়ই নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করে যাব, সে কাজের বিনিময়ে যা প্রাপ্য তা নেব। কিন্তু আমার প্রচেষ্টা আর প্রাপ্য এ দু’য়েরই যে একটা পরিসীমা আছে, সেটাও পাশাপাশি মনে রাখব। যদি না রাখি তাহলে নাম আর বিত্তের পিছনে ছুটতে-ছুটতে এমন কোনও বড় ভুল করে বসব যা অসংশোধনীয়।
এ সমস্যা আমারও হয়, যখন সকালে একটা শো করে ফের বিকেলে আর একটা শো করি। হয়তো দুটোই আমার প্রিয় নাট্যদল, দুটোই আমার প্রিয় চরিত্র, অভিনয়ের দিক থেকে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং, এবং অভিনয়টা করেও আমি অসম্ভব একটা আনন্দ পাই, অনাবিল আনন্দ। কিন্তু ওই আনন্দ পাওয়ার মধ্যে কোনও বিপদ ঘনিয়ে ওঠে না তো? পাতা থাকে না তো কোনও ফাঁদ? শঙ্খ ঘোষের একটা কবিতায় আছে ‘গভীর ঘুমের মধ্যে/ হাসিখুশি মুখে সর্বনাশ এসে দাঁড়ায়/ তার আদরে আদরে ভরে যেতে থাকে আমার অপাবৃত শরীর।/ ক্ষতগুলি চেনা যায় জেগে উঠবার বহু পরে।’ এই যে একটা শো থেকে আর একটা শো, একটা অভিনয় থেকে আর একটা অভিনয়, ক্রমাগত দৌড়ে চলেছি ওই দৌড়টাই আসলে ‘গভীর ঘুম’, আর তার মধ্যেই ‘সর্বনাশ এসে দাঁড়ায়’। যে অ্যাচিভমেন্ট বা সাফল্যের জন্যে এই দৌড়, সেটাই ‘অলীক সুখ’। তারপর যখন সম্বিত ফেরে, তখন বুঝতে পারি ‘ক্ষতগুলি চেনা যায় জেগে উঠবার বহু পরে’।
অথচ এটাকে কাজ মনে করেই আমি দৌড়চ্ছিলাম, নিজেকে পুরোদস্তুর পেশাদার প্রমাণ করার জন্যেই। কিন্তু আমার এই কর্মসচেতনতার তলায় অচেতনে কোথাও অহংকার লুকিয়ে থাকে না কি? প্রশ্নটা প্রায়ই আমাকে কুরে-কুরে খায়। হয়তো প্রতিটি পেশার প্রতিটি এগিয়ে-থাকা মানুষকেই। অথচ প্রশ্নটাকে আমরা এড়িয়ে যেতে থাকি। আসলে প্রশ্নটাকে নয়, এড়াচ্ছি নিজের সঙ্গে নিজের মুখোমুখি হওয়াটাকে। আয়নার সামনে চুলের মুঠি ধরে নিজেকে টেনে আনতে আমরা যে ভয় পাই। নিজের ভিতরের মানুষটাকে পুরো দেখে ফেললে ভারী অস্বস্তি হয়, সব রকমের গোলমাল আর অকিঞ্চিৎকর ব্যাপারস্যাপারগুলো ধরা পড়ে যায়। এখানেও শঙ্খ ঘোষ এসে পড়েন, ‘একার সঙ্গে মুখোমুখি হলো একা।’ সত্যিই যদি একার সঙ্গে মুখোমুখি হতে পারতাম একা, বোঝাপড়া করতে পারতাম, হয়তো বেঁচে যেতাম সর্বনাশের হাত থেকে।
বেঁচে থাকার এই বোধটা প্রখর ছিল শিশিরকুমার ভাদুড়ির। যখন তিনি তুমুল জনপ্রিয়, সাফল্য-খ্যাতির তুঙ্গে, তখনও তিনি অনায়াসে রুস্তমজি ধোতিওয়ালা’র ম্যাডান কোম্পানির নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। আর বেরিয়ে আসার সময় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘সীতা’য় রামের সংলাপ উচ্চারিত হয়েছিল তাঁর কণ্ঠে: ‘এই অন্তঃসারশূন্য গৌরব/ এ পাপ, পরি শুধু পুণ্য ছদ্মবেশ’। মানুষটার সঙ্গে বসবাস করি তো এখন, ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’-এ শিশিরকুমারের চরিত্রটা আমাকে করতে হয়, ওঁর অভিনীত চরিত্রের সংলাপগুলো যেন নিজের সংলাপ বলে মনে হয়।
‘অলীক সুখ’-এর ডাক্তারের কথায় ফিরে আসি। সে তো আসলে সুখ চেয়েছিল, তার বাবা-মা-বউ-বাচ্চাকে সুখী করতে চেয়েছিল, বলেওছে তার স্ত্রীকে এ সব কার জন্যে করছি? তোমাদের সুখের জন্যেই তো! ‘আন্তিগোনে’ নাটকে আন্তিগোনেও ক্রেয়নকে জিজ্ঞেস করেছিল ‘সুখ কাকে বলে?’ ক্রেয়ন বলেছিল ‘যতটুকু সুখ তুমি জীবন থেকে আদায় করে নিতে পারো, ততটুকুই জীবন, তার বেশি কিছু নয়।’ ক্রেয়নের কথা মেনেই বোধহয় আমরা কিংবা ‘অলীক সুখ’-এর ডাক্তারটি সুখ আদায় করার জন্যে ছুটে চলেছি। যতটুকু সুখ ততটুকুই জীবন এমন এক অলীক তাড়নাই আমাদের ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে।
এ ভাবে নিশ্চয়ই প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায়, জীবনে লব্ধপ্রতিষ্ঠ হতে হবে এমন উপদেশ শুনতে-শুনতেই তো বড় হই আমরা। তাছাড়া, সমাজে সম্মাননীয় হয়ে ওঠায় আপত্তিই-বা কোথায়? আমি-আপনি সকলেই তো চাই এমন অভীষ্ট বা লক্ষ্যে পৌঁছতে। শুধু পৌঁছনোর পথটা নিয়ে যেন একটু সতর্ক থাকি, মানবিক বোধগুলিকে যেন ছেঁটে না ফেলি...
না হলে অভীষ্ট পূরণের পর কোনও এক দিন যখন একা-একা কথা বলব নিজের সঙ্গে, ফের শঙ্খ ঘোষের কবিতা এসে বিব্রত করবে: ‘সম্মানের অপমানে তুমি কি গিয়েছ খুব ঝুঁকে?’


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.