সারদা গোষ্ঠীর মতো বেআইনি লগ্নি সংস্থাগুলির কাজকর্ম নিয়ে তদন্তের ভার সিবিআই-কে দেওয়ার ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মতামত জানতে চাইল সুপ্রিম কোর্ট। এ রাজ্যের পাশাপাশি শুক্রবার ওড়িশা, গুজরাত, মহারাষ্ট্র এবং অন্ধ্রপ্রদেশকেও একই নোটিস জারি করেছে প্রধান বিচারপতি আলতামাস কবীরের বেঞ্চ। লগ্নি সংস্থাগুলির বেআইনি কাজকর্ম নিয়ে ওড়িশার এক আবেদনকারীর দায়ের করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতেই এই নোটিস পাঠিয়েছে শীর্ষ আদালত। আবেদনকারীর আইনজীবীর দাবি, আদালতের প্রশ্নের জবাবে সিবিআই-এর তরফে ইতিমধ্যেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, তদন্ত করতে তাদের কোনও আপত্তি নেই।
এ দিকে, এই মামলা ও সিবিআই-এর সম্মতির পিছনে কংগ্রেসের হাত দেখছে তৃণমূল। ঘটনাচক্রে মামলাটি যিনি করেছেন, সেই অলোক জেনা অতীতে ওড়িশা থেকে কংগ্রেসের হয়ে ভোটে লড়েছেন। তিনি তাঁর আবেদনে বলেছেন, বিভিন্ন লগ্নি সংস্থার হাতে ওড়িশার ২০ লক্ষ পরিবার প্রতারিত হয়েছে। এই সব সংস্থাগুলির সঙ্গে রাজ্যের মন্ত্রী ও শাসক দলের বিধায়কদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের অভিযোগ উঠেছে। শুধু ওড়িশা নয়, পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশের মতো প্রতিবেশী রাজ্যগুলিতেও এই সংস্থাগুলি কারবার চালাচ্ছে। তাই গোটা বিষয়টির সিবিআই তদন্ত হোক।
এই আবেদনের ভিত্তিতে সিবিআই-এর মত জানতে চায় সুপ্রিম কোর্ট। জেনার আইনজীবী সুরেশ ত্রিপাঠী বলেন, “সিবিআই-এর তরফে অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল সিদ্ধার্থ লুথরা জানান, সিবিআই-প্রধান লিখিত ভাবে জানিয়েছেন, তদন্তের ভার নিতে কোনও আপত্তি নেই।” এর পরেই প্রধান বিচারপতি অন্য রাজ্যগুলিকে নোটিস জারি করে। রাজ্যগুলিকে চার সপ্তাহের মধ্যে সিবিআই তদন্ত নিয়ে অবস্থান জানাতে বলা হয়েছে।
সারদা কাণ্ডের সিবিআই তদন্তের দাবি আগেই তুলেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতারা। কিন্তু এই সংক্রান্ত জনস্বার্থ মামলার রায়ে আপাতত রাজ্য পুলিশকে দিয়েই তদন্ত করানোর কথা বলেছে কলকাতা হাইকোর্ট। সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়েছে। তার পরেও ওড়িশা থেকে এই মামলা এবং তার উত্তরে সিবিআই-এর তদন্তে রাজি হওয়া সম্পর্কে তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ের মন্তব্য, “তৃণমূলকে চাপে ফেলতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই কংগ্রেস এই সব মামলা করাচ্ছে। সিবিআই-কে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করছে তারা। কয়লা কেলেঙ্কারি-সহ একাধিক ক্ষেত্রে সিবিআই-এর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। খোদ শীর্ষ আদালত সেই প্রশ্ন তুলেছে।”
তৃণমূল সাংসদদের বিরুদ্ধে সিবিআই-কে কাজে লাগানো হচ্ছে বলে অভিযোগ তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে গিয়ে একের পর এক জনসভায় কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলছেন তিনি। তৃণমূল নেতাদের বক্তব্য, সারদা কাণ্ড নিয়ে যা যা তদন্ত করার দরকার, রাজ্য সরকার তা করছে। হাইকোর্টের নজরদারিতে সেই তদন্ত হচ্ছে। ফলে কংগ্রেস তাকে প্রবাবিত করার কোনও সুযোগ পাচ্ছে না। তাই কৌশলে ঘুরপথে সুপ্রিম কোর্টে সিবিআই তদন্তের দাবি তোলা হচ্ছে। প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের অবশ্য যুক্তি, “আমরা মানুষের স্বার্থেই সিবিআই তদন্ত চাইছি। ভবিষ্যতে যাতে এ ভাবে গরিব মানুষকে প্রতারিত না হতে হয়, সেটাও দেখা দরকার।”
সুপ্রিম কোর্ট চার সপ্তাহ সময় দিলেও পশ্চিমবঙ্গের তরফে শুক্রবারই সিবিআই তদন্তের ব্যাপারে আপত্তি জানানো হয়েছে। রাজ্য সরকারের আইনজীবী (অ্যাডভোকেট-অন-রেকর্ড) অভিজিৎ ভট্টাচার্য প্রধান বিচারপতির সামনে যুক্তি দেন, এই মামলার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের কোনও সম্পর্ক নেই। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগও নেই। আবেদনকারীরা ওড়িশার জন্যই সিবিআই তদন্ত চাইছেন। তাই এই মামলায় পশ্চিমবঙ্গকে জড়ানোর কোনও অর্থই হয় না। প্রধান বিচারপতি তখন রাজ্যকে লিখিত বক্তব্য জানাতে বলেন।
রাজ্যের সরকারি আইনজীবীদের বক্তব্য, আসলে অন্যান্য রাজ্যকে সামিল করা না হলে সংবিধানের ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টে মামলা করা যায় না। শুধুই ওড়িশার বিষয় হলে সুপ্রিম কোর্ট রাজ্যের হাইকোর্টে যেতে বলবে। সেই কারণেই অন্য রাজ্যকে মামলায় জড়ানো হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের আইনজীবীর মতো ওড়িশার আইনজীবীও সুপ্রিম কোর্টে সিবিআই তদন্তের বিরোধিতা করেছেন। তারা যুক্তি দিয়েছেন, নবীন পট্টনায়কের সরকার বিচারবিভাগীয় কমিশন গঠন করেছে। রাজ্য পুলিশ এই মামলার তদন্ত করছে। প্রতারিত পরিবারগুলির সাহায্যের জন্য একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে।
কিন্তু অসম, ত্রিপুরার মতো রাজ্যগুলি আগেই সিবিআই তদন্তে সায় দিয়ে রাখায় চাপে থাকছে পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা। এখন অন্ধ্র, মহারাষ্ট্র, গুজরাত কী অবস্থান নেয়, সেটাই দেখার। |