|
|
|
|
|
|
|
একটা[ভয়]কষ্টলজ্জাঘেন্না |
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
|
যা ঘটার সেটা দিন তিনেক আগে ঘটে গিয়েছে। পরের দিনগুলো একটা একটা করে গলায় যেন আটকে রয়েছে। কেটে যাচ্ছে না।
ঠিক তার তিন দিন আগের কথা। সকাল এগারোটা-সাড়ে এগারোটা হবে, খবর পাচ্ছি ইন্দিরা গাঁধীর নাকি গুলি লেগেছে। খবরটা তখনও কনফার্মড নয়। তবু যদুবাবুর বাজারের কাছে শিখ ট্যাক্সিওয়ালাদের প্রচণ্ড মারছে মানুষজন। তার পর হাতের কাছে যত জন যেমন শিখ পাওয়া যায়, পেটানো চলছে। আমাদের বাড়ির ঠিক উলটো ফ্ল্যাটে থাকে গোগি, বান্টি, হাপ্পিরা। বলতে গেলে আমার বন্ধু, কিন্তু আসলে ভাই-বোনও, আমার কনশাস, সাব-কনশাস, আনকনশাসের খুব কাছে।
ওরা সবাই স্কুলে তখন। হঠাৎ আমাদের বাড়ি দরজা ঠেলে ঢুকে এলেন আন্টি, উদ্ভ্রান্ত একেবারে। ভয়ে, কান্নায় কুঁকড়ে গিয়েছেন। বললেন, ‘দাদা, বাচ্চারা এখোনো আসেনি স্কুল থিকে।’ বাবা বাড়িতে ছিলেন। দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন। কিছু ক্ষণ পরে আমার বন্ধুদের বাড়ি দিয়ে গেলেন অবশ্য ওদেরই এক আত্মীয়। সে দিন বিকেল থেকেই একটা যেন কাঁটাতার পড়ে গেল আমার আর গোগির মধ্যে, আমি সেটা স্পষ্ট দেখেছিলাম ওর চোখে।
পরের সপ্তাহটা ঘোরের মধ্যে কেটেছিল। যেন মলিন আলোয় একশো তিন জ্বর আর নামছিল না। হঠাৎ হঠাৎ অবিশ্বাস্য সব দৃশ্য আসছিল আর মিলিয়ে যাচ্ছিল। দিন তিনেকের মধ্যে ওপেন ভায়োলেন্স যদিও কমে গিয়েছে। কিন্তু গলিগলতায় শিখ দেখলেই মার মার মার। শিখরা বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন না। অনেকেই তুরন্ত কলকাতা ছেড়েছেন।
সে দিন কার্ফু চলছে। বাবা আর পাড়ার জনাকয়েক আমাদের বাড়ির নীচে কথা বলছেন। এমন সময় আন্টি তাঁর তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে উপস্থিত, ‘দিদি, উরা আমাদিরকে... মার দেঙ্গে উয়ো লোগ।’ পরিস্থিতিটা বুঝতে মায়ের পাঁচ সেকেন্ড সময় লেগেছিল। জানলা দিয়ে দেখলাম ক’জন ছেলে এসে একটু রোয়াব নিয়েই বাবাকে বলল, ‘আচ্ছা, আপনাদের বাড়ির সামনেই একটা শিখ ফ্যামিলি থাকত না?’ বাবা একটুও থতমত না খেয়ে বলল, ‘ওরা নেই। আত্মীয়ের বিয়ে, তাই পঞ্জাব গিয়েছে।’ ‘কিন্তু ক’দিন আগেও তো দেখেছি।’ বাবা বলল, ‘হ্যাঁ, ক’দিন আগেই তো গেল।’ এ বার শাসানি, ‘আপনি ওদের বাঁচানোর চেষ্টা করছেন না তো? যদি করেন তা হলে আপনার কিন্তু ভাল হবে না।’ ছেলেগুলো গেল না আমাদের বাড়ির সামনে থেকে। টহল দিতে থাকল। নীচের গলি থেকে গোগিদের বাড়িটা দেখার চেষ্টা করল। মা তখন ওদের নিয়ে আমাদের একটা ঘরে আলো নিভিয়ে বসে।
আর আমি জানলা ফাঁক করে প্রাণপণ বোঝার চেষ্টা করছি ছেলেগুলো গেল কি না। কাঠ হয়ে ভাবছি, যদি এরা চলে না যায়, তা হলে হয়তো আজ আমি দেখব ভয়ঙ্কর খুন, রক্ত আর এমন একটা বিচ্ছেদ যার তুলনা হয়তো দেশভাগের হিংসার সঙ্গে এক রকম। সব থেকে বড় এতগুলো মানুষ খুন হয়ে যাবে আমার সামনে? মানে যে মানুষগুলো আমার সামনে খাচ্ছিল, ঘুরছিল, ভয় পাচ্ছিল— তাদের মেরে ফেলা হবে এবং আমরা কিছুই করতে পারব না! তিলে তিলে খুব যন্ত্রণা দিয়ে আমার সামনে বা পেছনে মেরে ফেলা হবে! ওদের প্রাণ বেরোতে কত ক্ষণ লাগবে? অত ক্ষণ ওরা ছটফট করবে? আর আমাদের সঙ্গে কথা বলবে না, সরসোঁ দা শাগ আর এক মুখ হাসি নিয়ে আসবে না আমাদের বাড়ি, আমরা বিকেলে একসঙ্গে খেলব না? ওদের হয়তো টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাবে। ওরা জানবে যে ওদের মেরে ফেলা হবে। কিন্তু ওদেরও কিছু করার থাকবে না! আমার গা গুলোচ্ছে, ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে, বাথরুম পেয়ে গিয়েছে। পা দিয়ে কী যেন নামছে, বুক ধড়ফড় করছে।
সময়টা বেশি ক্ষণ ছিল না। মিনিট দশেক। তবে জীবনের অনেকগুলো নিশ্চিতকে পালটে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। |
|
|
|
|
|