|
|
|
|
|
|
|
সুমনামি |
কবীর সুমন
|
মনে আছে, আমার বয়স তখন ছ’বছর। দম ঘোরানো গ্রামোফোনে খান সাহেব আব্দুল করিম খানের গান বাজছে। শিল্পীর গলা খুবই মিহি। গানটি তিনি ধরেছেনও খুব চড়ায়। গুনগুন করে একটু গলা মেলাতে গিয়ে দেখছি— ওরে বাবা, এর চেয়ে বোধহয় নারকোল গাছে চড়াও সহজ। মিহি গলার গানটি শুধু তার সুর আর শিল্পীর গায়নশৈলীর অদ্ভুত সারল্য ও স্বচ্ছন্দে সুরে-সুরে ঘুরে বেড়ানো দিয়ে আমায় ধরে ফেলছে। এক জায়গায় শিল্পী গাইছেন— র্সা/নি ধ/সসা-র্সানিধপমগরেসানিধ- সারেগ...সা। সরগমটি তিনি করছেন আলতো করে। যেন ওই স্বরগুলি স্পষ্ট উচ্চারণের কোনও দায় তাঁর নেই। শুদ্ধ গান্ধার থেকে ষড়জে এলেন শিল্পী প্রায় না-ফেরার মতো করে, এত হালকা মিড়। বা না-মিড়। তখনই মনে হল এই সুরটি থেকে গেল আমার সঙ্গে। থেকে গেছেও। কত অদ্ভুত সময়ে যে সে এসে পড়েছে আমার মাথায়। গুনগুন করে উঠেছি।
বাবা বলছেন, আব্দুল করিম খান সাহেব গাইলেন ঝিঁঝিট-খামাজ রাগ। ঠুংরি। নতুন রেকর্ড বসিয়ে দিচ্ছেন তিনি গ্রামোফোনে আর আমি দম দিয়ে দিচ্ছি— স্টিলের ঝকঝকে হাতলটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। খান সাহেব গাইছেন ‘যমুনা কি তীর’। বাবা বলে দিচ্ছেন, বুঝলি, এটা ভৈরবী। ভৈরবী তো বুঝলাম, কিন্তু কী চড়া রে বাবা! আগের ঠুংরিটা তবু মধ্যসপ্তকে মোটামুটি ছিল। একটি জায়গাতেই মধ্যসপ্তকের পঞ্চম থেকে বিদ্যুতের মতো একটি তান করে তারসপ্তকের মধ্যম ছুঁয়ে শুদ্ধ গান্ধার। কিন্তু ভৈরবী রাগের এই গানটা এত চড়া যে মনে হচ্ছে উনি আকাশ ছাড়িয়ে কোথাও চলে গেলেন। এই গান শিল্পী শুরুই করছেন তারসপ্তকের কোমল গান্ধার থেকে তারের ষড়জে। তীক্ষ্ন, তীব্র, বেপরোয়া। কিন্তু তলার দিকে তাঁর গলা মধ্যসপ্তকের ষড়জের নীচে আসছেই না।
খান সাহেব আব্দুল করিম খানের ছোট খেয়ালের রেকর্ড পরে আরও শুনেছি। এখনও শুনি। মধ্য লয় তিন তালে বসন্ত রাগের খেয়ালটি তো মনে হয় এই রাগের শেষ কথা। কিন্তু এও বলব যে, এই মহাশিল্পীর কণ্ঠ সারা ক্ষণ তারসপ্তক-প্রবণ হওয়ায় আর গলার আওয়াজ অত চড়া হওয়ায় একটা অপূর্ণতাবোধ থেকেই যায়। শুধু তারসপ্তকের আওয়াজে মন ভরে না। মন্দ্রসপ্তক ও মন্দ্রধ্বনির এমন পূর্ণগ্রাস যে একমাত্রিক করে তোলে কণ্ঠসংগীতকে।
মিলিয়ে দেখেছি, ওস্তাদ আব্দুল করিম খান সাহেব ‘এফ-শার্প’ পরদায় গাইতেন। মন্দ্রসপ্তকে তাঁর গলা প্রায় ছিলই না। তাঁর শিষ্য সোয়াই গন্ধর্বও একই পরদায় গাইতেন। তাঁর গাওয়া ছোট খেয়ালের একটি সিডি সংকলনও পাওয়া যায়। গলায় কী সুর! এক চুলও এ দিক ও দিক নেই। প্রতিটি স্বরপ্রক্ষেপ মাপা। কালোয়াতি কম, গান বেশি। আজকালকার কিছু খেয়াল গায়কের তান আর মুড়কির মাদারির খেল শুনে ও তার চেয়েও বেশি দেখে যাঁরা বিরক্ত, তাঁরা এক বার শুনে দেখতে পারেন। হাঁপ ছেড়ে বাঁচবেন তবু— গান শুনে। সমকালীন কালোয়াতি ও দ্রুত লয়ের আধিক্যের মতো, দু’একজন বাদে প্রায় সমস্ত পুরুষ ধ্রুপদী কণ্ঠশিল্পীর চড়া পরদায় খেয়াল গাওয়ার রীতিটাও আমাকে ভাবিয়ে তোলে। |
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
উপমহাদেশের পুরুষ খেয়ালশিল্পীরা দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বেশ উঁচু পরদায় গান করে গিয়েছেন ও করে যাচ্ছেন। কেন? ওস্তাদ ফৈয়াজ খান ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি তখনকার বি-ফ্ল্যাট পরদায় গাইতেন। তখনকার বি-ফ্ল্যাট হল আজকের হিসেবে ‘বি’ বা বি-ন্যাচারাল। সমকালে ৪৪০ হার্ট্জ-এ ‘এ’ পরদা— এই নিরিখে যন্ত্র সুরে মেলানো হয়ে থাকে। পাশ্চাত্য সংগীতের বিচারে ‘বি-ফ্ল্যাট’ (‘বি’-এর চেয়ে আধ পরদা কম) ও ‘বি’ পুরুষকণ্ঠে ব্যারিটোন। ‘সি’ হল টেনর। ওস্তাদ ফৈয়াজ খান ছিলেন ব্যারিটোন কণ্ঠের অধিকারী। আগ্রা ঘরানায় তাঁর ছাত্রদের মধ্যে কেউ কেউ ‘সি’ পরদা থেকেও গেয়েছেন। কিন্তু ‘সি-শার্প’ বা ‘ডি’ থেকে (‘এফ’ বা ‘এফ-শার্প’ তো দূরের কথা) খেয়াল গেয়েছেন এমন কোনও খ্যাতিমান শিষ্য তাঁর ছিল বলে আমার অন্তত জানা নেই।
ওস্তাদ ফৈয়াজ খান সাহেবের গান ‘বি’ পরদায় তাঁর গমগমে মন্দ্রধ্বনির জন্য একটা মাত্রা দেয়, যা তাঁর পরবর্তী বেশির ভাগ পুরুষকণ্ঠে পাওয়া যায়নি। ওস্তাদ আমীর খান সম্পর্কে ভারতের বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন— তিনি আমাদের মন্দ্রসপ্তক দিয়ে গিয়েছেন। ঠিকই। স্বরবিস্তারে ও সরগমে মন্দ্রসপ্তকের এমন ঘনত্ব ও প্রাধান্য আর কারও খেয়ালে পাওয়া যায় না। গাইতেন তিনি ‘ডি’ পরদা থেকে। মন্দ্রসপ্তকের শুদ্ধ গান্ধার স্পর্শ করতে পারতেন তিনি, যে ক্ষমতা উপমহাদেশের খুব কম পুরুষ খেয়ালশিল্পীর ছিল। ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানকে শোনা গিয়েছে অতি-মন্দ্রসপ্তকের ষড়জে দাঁড়াতে। চড়ায় ওস্তাদ আমীর খান তারসপ্তকের পঞ্চম ছুঁতেন— কিন্তু তান করতে গিয়ে। আমি তাঁর এমন কোনও রেকর্ডিং বা অনুষ্ঠান শুনিনি (পোষা কুকুরের মতো তাঁর অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানে আমি ঘুরেছি ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৪-এ, তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত), যেখানে তিনি তারের পঞ্চম বা মধ্যমে ঠায় রয়েছেন কিছু ক্ষণ। এটি খান সাহেব আব্দুল করিম খান, ওস্তাদ ফৈয়াজ খান, পণ্ডিত ডি ভি পালুস্কর, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান, পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুর, ওস্তাদ সালামাত আলি ও ওস্তাদ নাজাকাত আলি (পাকিস্তান), ওস্তাদ নিয়াজ আহমেদ ও ওস্তাদ ফৈয়াজ আহমেদ, পণ্ডিত মল্লিকার্জুন মনসুর, পণ্ডিত ভীমসেন জোশির খেয়ালে পাওয়া যেতই। অর্থাৎ, ওস্তাদ আমীর খান তাঁর সুরগম্ভীর কণ্ঠ নিয়ে মন্দ্র ও মধ্যসপ্তকেই বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন। ‘ডি’ পরদায় না গেয়ে তিনি যদি ‘সি’ থেকে গাইতেন, তা হলে আমরা হয়তো ফৈয়াজ খান ধরনের আর একটা আওয়াজ পেতাম, কারণ তাঁর গলাটাই ছিল গম্ভীর।
উপমহাদেশের পুরুষ খেয়ালশিল্পীরা অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে যে সকলেই কেন চড়া পরদায় মোকাম বানিয়েছিলেন, তা নিয়ে কোনও আলোচনা হয়েছে কি? তানপুরার বেলাতেও দুটি ভাগ: ‘জেন্টস’ আর ‘লেডিজ’। পুরুষদের তানপুরা এমন ভাবে তৈরি যে তার আওয়াজ ‘সি’ থেকে খোলে। আরও উঁচু পরদায় আরও খুলবে। ‘জি’, ‘জি-শাপর্’, ‘এ’, ‘বি-ফ্ল্যাট’ পরদাগুলোর জন্য ‘লেডিজ’ তানপুরা। অর্থাৎ ধরেই নেওয়া হচ্ছে যে বেস ও ব্যারিটোন কণ্ঠের অধিকারীরা কেউ ধ্রুপদী গান গাইবেন না। ওস্তাদ ফৈয়াজ খান সাহেবের তানপুরাটা কি বিশেষ ভাবে তৈরি করা হয়েছিল? কোনও মহিলাশিল্পী যদি উঁচু পরদায় গান করেন, তাঁর বেলা?
উপমহাদেশের পুরুষ খেয়াল-ঠুংরিশিল্পীদের মধ্যে ব্যারিটোন বা বেস গলার অভাব এবং নিচু পরদায় গান না-গাওয়ার রীতি ধ্বনির দিক দিয়ে একটা একমাত্রিকতা ও একঘেয়েমি সৃষ্টি করেছে। তেমনি, এক কালের কেসরবাঈ কেরকার, হিরাবাঈ বরোদেকর, গাঙ্গুবাঈ হাংগল ও কিছুটা সুনন্দা পট্টনায়েকের পর একটু মোটা আওয়াজের মহিলাশিল্পী কমই আসায় নারীকণ্ঠের খেয়ালেও এসেছে ধ্বনির দিক দিয়ে একঘেয়েমি। উপমহাদেশের ধ্রুপদী গান গাওয়ার প্রবণতা হয়ে পড়েছে মধ্য ও তারসপ্তকে সীমাবদ্ধ। কে কত চড়ায় যেতে পারে তার প্রতিযোগিতা। সংগীতের বিচারে এটি সুখবর নয়।
পঙ্কজকুমার মল্লিক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও দেবব্রত বিশ্বাসের মতো ব্যারিটোন কণ্ঠ যদি খেয়ালেও পাওয়া যেত! |
|
|
|
|
|