|
|
|
|
|
|
শিল্প যখন ঠোঁটকাটা থাপ্পড়বান |
আজকের হিরো: অ্যান্টি ম্যাটার ম্যানিফেস্টো
|
গৌতম চক্রবর্তী |
সাররিয়ালিস্ট পর্বে তখন ফ্রয়েড আমার বাবার মতো। অন্তর্গত জগৎকেই ফুটিয়ে তুলছি। আজ বহির্গত জগৎ ও পদার্থবিজ্ঞান সেই মনস্তাত্ত্বিক জগৎকে ছাপিয়ে গিয়েছে। আজ আমি ফ্রয়েডের নই, কোয়ান্টাম-বিজ্ঞানী হাইজেনবার্গের সন্তান।—১৯৫৮ সালে এ ভাবেই সালভাদর দালি লিখেছিলেন তাঁর ‘অ্যান্টি ম্যাটার ম্যানিফেস্টো’।
শিল্পীর জীবন ও চেতনা বিভিন্ন সময়পর্বে কী ভাবে বাঁক নেয়, তারই উজ্জ্বল উদ্ধার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে দালির এই ম্যানিফেস্টো। এখানে পুরনো বন্ধুরা— আঁদ্রে ব্রেতঁ, লুই আরাগঁ কিংবা বুনুয়েল আর তাঁর সঙ্গী নন। ১৯৪১ সালে নিউ ইয়র্কে প্রদর্শনীর পরে দালি ধুয়ো তুলেছিলেন, ‘আমাকে ক্লাসিক হতে হবে।’ ধ্রুপদী যুগের চিত্রকলা, পদার্থবিজ্ঞান, খ্রিস্টীয় অতীন্দ্রিয়বাদ সব মিলেই সালভাদর দালি তখন নতুন চিত্রভাষার সন্ধানে।
এই সন্ধান পুরোপুরি ব্যক্তিগত। ঘটনার শুরু ১৯৪৫ সালের ৬ অগস্ট। সালভাদর দালি ও তাঁর স্ত্রী গালা তখন নিউ ইয়র্কে। সে দিন সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে জাপানি রেডারে ধরা পড়ল হিরোশিমার আকাশে এগোচ্ছে তিনটি মার্কিন বম্বার। মাত্র তিনটি বিমান, মানে যুদ্ধ নয়। শত্রুরা চক্কর কাটতে এসেছে ভেবে বিমানগুলি আটকানোর চেষ্টা হয়নি, অ্যান্টি এয়ারক্রাফ্ট কামানগুলিও গর্জায়নি। কিছু ক্ষণ পরেই ৬৪ কেজি তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়ামে তৈরি বোমা ‘লিট্ল বয়’ ছুড়ে দেওয়া হল ‘এনোলা গে’ বিমান থেকে। বিস্ফোরণ, আগুনের ঝড়, ছাতার মতো ধোঁয়ায় নিমেষে ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু। ৭০ হাজার আহত। পরবর্তী প্রজন্মেও তেজস্ক্রিয়তার বিষ কী ভাবে ছড়িয়ে যাবে, ইয়ত্তা নেই। যুদ্ধে প্রথম পরমাণু বোমার ব্যবহার।
এই বোমা বিস্ফোরণকে তখন ব্রেতঁ, বুনুয়েল সকলেই মনে করছেন, সভ্যতার অভিশাপ। দালিও লিখছেন, ‘সেই বিস্ফোরণ আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তার পর পরমাণুই হয়ে দাঁড়াল আমার চিন্তাভাবনা, মনন ও মস্তিষ্কের প্রধান খাদ্য।’ অন্যদের মতো দালি তখন পরমাণু বোমা নিয়ে ভ্যালু-জাজমেন্ট দিচ্ছেন না, বিজ্ঞান অভিশাপ না আশীর্বাদ: সেই গোলকধাঁধায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন না। সমস্ত গরু, ভেড়া, মানুষ, গাছপালা নিয়ে আস্ত একটা শহরের অস্তিত্ব লোপ পেল! পার্থিব ও নশ্বর অস্তিত্ব কি ইলেকট্রন, প্রোটনের মতো ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে গেল পারমার্থিক কক্ষপথে? চেতনা, পদার্থ আর শক্তি কি একই মৌলিক অস্তিত্বেরই রূপান্তর নয়? ‘বিজ্ঞানের তুমুল অগ্রগতি সত্ত্বেও, আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে আমরা নিকৃষ্ট অবস্থানে। পদার্থবিদ্যা আর অধিবিদ্যার মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছে’, লিখছেন দালি।
এই সব অধিবিদ্যা, আধ্যাত্মিকতা গোছের শব্দবন্ধ থাকার কারণে দালির ‘অ্যান্টি ম্যাটার ম্যানিফেস্টো’ গোছের লেখাগুলি আধুনিক শিল্পবেত্তাদের কাছে গুরুত্ব পায়নি। আজ যখন বিজ্ঞানীরাও ঈশ্বর এবং বিজ্ঞানের পারস্পরিক সম্পর্ক রীতিমত খুঁটিয়ে দেখতে চাইছেন, ওই ম্যানিফেস্টোর গুরুত্ব অনেক। মহাযুদ্ধের পরই ১৯৫২ সালে দালি লিখেছিলেন তাঁর ‘মিস্টিকাল ম্যানিফেস্টো’। ‘বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে মুগ্ধ শিল্পীরা আজ বস্তুবাদে আচ্ছন্ন। তাঁদের নতুন কিছু আর আঁকার নেই। অস্তিবাদী উদ্বেগ, সাররিয়ালিস্ট অস্থিরতা, যাবতীয় নেতিবাদ আজ সমাপ্ত। ব্যক্তির চূড়ান্ত আনন্দ এখন অতীন্দ্রিয় অনুভূতিতে আর মরমিয়া বোধে’, লিখেছিলেন দালি। তার পর সেই ‘নিউক্লিয়ার মিস্টিসিজম’ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন বক্তৃতা-সফরে। |
|
ক্রুসিফিক্সন |
এই নিউক্লিয়ার মিস্টিসিজম বা পারমাণবিক অতীন্দ্রিয়বাদের বছরগুলিতে কী হচ্ছে? ১৯৪৯ সালেই শিল্পী এঁকে ফেলেছেন ‘ম্যাডোনা অব পোর্ট ইওগাত’(Lligat)। গালা সেখানে শিশু খ্রিস্টকে কোলে নিয়ে কুমারী মায়ের মডেল, কিন্তু তাঁর হাত-পা বিচ্ছিন্ন। মাথাটাও মাঝামাঝি ছিন্ন। পরে দালি লিখবেন, ‘দুটি পরমাণু একসঙ্গে জোট বাঁধলে ফিউশন তৈরি হয়। হাইড্রোজেন বোমার তত্ত্ব সেটিই। বিজ্ঞান এবং ধর্মকে জুড়ে শিল্পীও সে রকম বিস্ফোরণ ঘটাতে পারেন।’ ঘটনা, ছবিটি তৎকালীন পোপ দ্বাদশ পায়াসকে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন দালি, তাঁর কাছে গালাকে খ্রিস্টীয় মতে গির্জায় বিয়ের অনুমতিও চেয়েছিলেন। তিরিশের দশকে পল এল্যুয়ারের স্ত্রী গালা দালির বাড়িতে থাকতে এসে আর ফিরে যাননি, দালির বাবা এই প্রেমের ঘোর বিরোধী ছিলেন। দুজনের সিভিল ম্যারেজ হলেও তখনও পর্যন্ত ছিল না বাইবেল শপথ করে ‘টিল ডেথ ডু আস পার্ট’ আবৃত্তির বিবাহবন্ধন। পরে ১৯৫৮ সালে ক্যাথলিক গির্জায় দুজনের বিয়ে। গালা আগে বিবাহিতা ছিলেন বলেই পোপের অনুমতি দরকার ছিল।
এই পর্বের দালি তা হলে সাররিয়ালিস্ট চেতনা ছেড়ে ঈশ্বরসন্ধানী মরমিয়া? এই প্রশ্নের উত্তর, দালির সাধনা তখনও ছবি নিয়ে। কিন্তু বদলে গিয়েছে বিষয়। সমুদ্রতটে কালো তারের নিঃসঙ্গ টেলিফোন আর আঁকেন না তিনি, নারীশরীর বেয়ে খুলে যায় না অজস্র দেরাজ এবং দূরে দগ্ধ হয় না কোনও জিরাফ। এখন বরং ‘ম্যাডোনা অব পোর্ট ইওগাত’ থেকে ‘ক্রাইস্ট অব সেন্ট জন অব দ্য ক্রস’ কিংবা ‘টেম্পটেশনস অব সেন্ট অ্যান্থনি’— একের পর এক ছবিতে খ্রিস্টীয় বিষয়। রেনেসাঁর শিল্পীদের ছবিগুলিকেই যেন নতুন রূপ দিচ্ছেন তিনি। ’৫৪ সালে আঁকা ‘ক্রুসিফিক্সন’ ছবিটি যেমন! ৭৬.৫ ইঞ্চি লম্বা ও ৪৮.৭ ইঞ্চি চওড়া ক্যানভাসে তেলরঙে ক্যাথলিক ধর্ম, অঙ্ক, বিজ্ঞান সব কিছু মিলেমিশে একাকার। ক্রুশকাঠ নয়, হাইপারকিউবে বিদ্ধ যিশুখ্রিস্ট। ঘনকে তিন মাত্রা, হাইপারকিউবে চার বা ততোধিক মাত্রা। এই হাইপারকিউবেই ঈশ্বরপুত্রের অতীন্দ্রিয় অস্তিত্ব। আমাদের চোখে, ত্রিমাত্রিক গোলক, ঘনক বা চোঙের মতোই, কখনওই ধরা দেয় না বহুমাত্রিক হাইপারকিউব। তাকে শুধু জ্যামিতিক সূত্রে উপলব্ধি করতে হয়। নীচে মাটি নেই, রয়েছে চৌখুপি দাবা বোর্ড। কাঁটার মুকুট, পেরেক বা রক্তপাত নেই। খ্রিস্ট অনেকটা ওপরে, যেন ঝুলে আছেন। মুখ পাশের দিকে। পায়ের কাছের মেরি মাগদালেন আর কেউ নন, স্বয়ং গালা। ঈশ্বর-পৃথিবী-ভালবাসার পথ বেয়েই দালি পৌঁছে যান চূড়ান্ত প্রশ্নে, ‘পরমাণুসজ্জার অদলবদলে এক ধাতু আজ সহজে রূপান্তরিত হতে পারে অন্য ধাতুতে। তা হলে রক্তমাংসের শরীর এবং মানুষী চেতনা কেনই বা অন্য রূপে বিশ্লিষ্ট হয়ে পৌঁছবে না স্বর্গে?’ স্বর্গ, ঈশ্বর, অতীন্দ্রিয়বাদ, মরমিয়াবাদ— এই শব্দগুলির কারণে আজও সম্মান পাবে না দালির শেষ পর্যায়ের ছবি এবং ম্যানিফেস্টো? তাঁকে শুধুই থেকে যেতে হবে ‘সাররিয়ালিজম’-এর গণ্ডিতে? একুশ শতকেও বিজ্ঞানমনস্কতা এবং সেকুলার গোঁড়ামি রয়ে যাবে এতটাই সুতীব্র ও সাংঘাতিক? আমাদের, বাঙালিদের অবশ্য মনে পড়তে পারে ঘরের কাছে আর এক জনের কথা। আপ্রাণ কমিউনিস্ট, কিন্তু মৃত্যুর দু’বছর আগে ডায়েরিতে লিখে গেলেন ব্যক্তিগত উপলব্ধি: দ্বৈতবাদ-অদ্বৈতবাদ একই জ্ঞানের উভয় দিক। শক্তিই আসল। শক্তির কোটি কোটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডব্যাপী প্রকৃত রূপ মানুষ কোনও দিন জানতে পারবে না। কিন্তু জানার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে অবিরাম।... সৃষ্টিরহস্য, বিশ্বের মূল নীতি কোনও দিনই জানা সম্ভব নয়। সে জ্ঞান অনন্ত এবং সীমাহীন।
ভদ্রলোকের নাম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়! |
|
|
|
|
|