গরিবরথ
তার আজ মোটে স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু মায়ের মুখের ওপর ‘না’ বলতে পারল না। অকারণ স্কুল কামাই করা মা পছন্দ করে না। সে যে রথ সাজাবে, সেইটে বুঝি কোনও কারণ হতে পারে না? এক বার সে বলেছিল, ‘স্কুলে গেলে রথ সাজাব কখন?’ মা শান্ত ভাবে বলল, ‘স্কুল আড়াইটেয় ছুটি হয়ে যাবে। তখন ফিরে সাজিয়ো।’
গত কাল সন্ধ্যাবেলা মায়ের সঙ্গে রথতলার হাটে গিয়েছিল সে রথ কিনতে। সঙ্গে জগন্নাথের মূর্তি। রথ সত্তর টাকা নিল। জগন্নাথ তিরিশ। তার জন্য মা কিছু বলেনি। তবে সে যখন রথ কিনে দেওয়ার আবদার জানায়, মা বলল, ‘এগারো বছর বয়স হল তোর। এখনও রথ? তুই বড় হবি না?’
তার একটু লজ্জা-লজ্জা হয়েছিল ঠিকই। তবে, মায়ের এই কথার মানেই সে বোঝেনি। বড়রা কি রথ টানে না? রথতলার বড় রথ যখন পথে নামে, তার রশি ধরে টানে তো বড়রাই। এমনকী রথের দোতলায় মহাব্যস্ত মুখে চড়ে বসে।
জগন্নাথের রথ যাচ্ছে, নাকি মানুষ চলেছে মানুষে টানা রথে চেপে, বোঝা শক্ত।
তারও ইচ্ছে করে ওমনি চাপবে বড় রথের দোতলায়, ওমনি টানবে রথের রশি, কিন্তু মা দেবে না। মা তাকে ভিড়ে ছাড়তে চায় না। এই যে আজ সন্ধ্যায় রথের মেলায় যাবে, মা সারাক্ষণ শক্ত করে তার হাত ধরে থাকবে। তার সমবয়সি বন্ধুরা দল বেঁধে বেড়ায়। আজ সকাল থেকে ছুটি তাদের। বেশির ভাগ বাংলা স্কুলে পড়ে। আজ তাদের রথের ছুটি। মা তাকে দিয়েছে ইংরিজি স্কুলে। ইংরিজি না শিখলে নাকি কিছুই করা যায় না আজকাল। তা হলে যারা বাংলায় পড়ছে, তাদের কী হবে? মা বলে, ‘তাদের বাবা আছে। টাকাপয়সা আছে। আমাদের যে কিছুই নেই রে।’ তা ঠিক। ইংরিজি স্কুলের খরচ সামাল দিতে গিয়ে মাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। স্কুলের ডেস্কে বসে হঠাত্‌ মায়ের জন্য ভারী কষ্ট হতে লাগল তার। শুধু এক দিন, একটু দড়ি ধরে টান দেবে বলে মায়ের একশো টাকা খরচ করিয়ে দিল সে! কী করে এমন অবুঝ হতে পারল? মা একটু সাজে না, ভাল কাপড় পরে না। নিজে মাছ খায় না, তবু তার জন্য নিয়ম করে হপ্তায় তিন দিন মাছ আনে। বলে, প্রোটিন না খেলে মাথা কাজ করে না।
ভারী বিষাদ নিয়ে সে বাড়ি এল। রঙিন কাগজে মোড়া তার রথখানি সাজাল রঙিন পাতাবাহারের পাতায়। সন্ধ্যাবেলা মায়ের সঙ্গে মেলায় গিয়ে সে বাঁশি কিনতে চাইল না। পাপড়ভাজা খেল না। তার সহপাঠীদের অনেকেই পুরী গিয়েছে। কেউ মায়াপুর বা নবদ্বীপ। মাহেশের রথ দেখতেও যাবে অনেকে। এই সব গল্প আগের মতো খলবলিয়ে শোনাতে বসল না মাকে। নিজের হাতখরচ থেকে বাঁচানো টাকায় সে মেলা থেকে কিনল একটি বকুল চারা। মা ভালবাসে বকুল। উঠোনে পুঁতে দেবে। ফুল ফুটবে যখন, তার শ্রান্ত মায়ের মন ভরে উঠবে গন্ধে। এটুকু দরকার। আজ সে বুঝেছে, যে রথটি মাকে টানতে হয় তিনশো পঁয়ষট্টি দিন, তার নাম গরিবরথ। তার চাকাগুলো সমান নয়। দড়িটি শীর্ণ। নড়বড়ে আসনে অধিষ্ঠিত যে জগন্নাথ, সে উদাসী। কে জানে, সে-ও কোনও ইংরিজি না-জানা গরিব কি না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.