সম্পর্কের তিক্ততা অবশেষে মেঠো বক্তৃতার হুমকিতে গড়াল। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডের বিরুদ্ধে ‘বদলা’র কথা বলে সেই বল গড়িয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং। তার পরে একে একে নেতা-মন্ত্রীরা। বাড়ানো বল পেয়েই সোজা গোলে!
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য বদলা নিতে চেয়েছেন ‘গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে’। সত্যি বলতে কী, তেমন বদলায় আপত্তির কী আছে, বোঝা কঠিন। কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ‘বদলা’ নেওয়ার যা যা প্রকরণ আমাদের জানা আছে, তাতে আর যা-ই থাকুক, মারধর-লাঞ্ছনা-খুন-ধর্ষণ থাকে না। তাই এমন বদলা বরং বাঞ্ছনীয়, যেখানে ভোটের মেশিনে বোতাম টিপে কিংবা আইনসভায় প্রস্তাব পাশ করে কোনও ‘অবিচার’-এর অবসান ঘটানো যায়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা তাঁর ‘বদলা’র হুমকিতে অন্তত সেই পরিসরটুকু রেখেছেন। তবু যাঁরা তাঁর ওই বক্তব্যকে খণ্ডিত ভাবে তুলে ধরে মমতার মুণ্ডপাতে ব্যস্ত, তাঁরা সত্যের অপলাপ করছেন বললে ভুল হবে না।
মদন মিত্রের বেলায় অবশ্য সে আবরু লোপাট। ময়দানি ভাষণে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার (উপরন্তু তিনি মহিলা) সম্পর্কে তাঁর বিবিধ উক্তি যে ভাবে সৌজন্য ও শালীনতার সীমা ছাড়াচ্ছে, তা খুব বেদনার। ক’দিন আগে মন্ত্রী মদনকে বলতে শোনা গিয়েছে, পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফল বেরোলে এই নির্বাচন কমিশনারের হাতে ‘বালা’ (হাতকড়া?) পড়ে যাবে এবং এখানে আর তাঁর দেখা পাওয়া যাবে না! তিনিই আবার অন্য এক নির্বাচনী সভায় মহিলা নির্বাচন কমিশনার সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘আমার চোখে উনি সুন্দরী নন’! |
জ্যোতি বসু ও টি এন শেষন। জুন, ১৯৯৫। ছবি: রাজীব বসু |
ব্যথা বাড়ে, যখন দেখা যায় মমতার মতো এক জন সংবেদনশীল মুখ্যমন্ত্রী মাথার উপরে থাকা সত্ত্বেও এক জন মহিলা আধিকারিক সম্পর্কে অশোভন কথাবার্তা বলে এঁরা অবলীলায় পার পেয়ে যাচ্ছেন! প্রশ্ন জাগে, সৌজন্য-শালীনতা-সংযম সবই কি তা হলে ‘আমরা-ওরা’-র কড়ি দিয়ে কিনতে হবে?
নির্বাচন কমিশনার এক জন সাংবিধানিক পদাধিকারী। তাঁর কোনও সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ কারও ভাল অথবা খারাপ লাগতেই পারে। পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘিরে মীরা পাণ্ডের সঙ্গে রাজ্য সরকারের যে নজিরবিহীন লড়াই চলছে, তা হয়তো আরও বাড়বে। কারণ সামনেই কলকাতা-সহ অনেকগুলি পুরসভার ভোট। ‘যুদ্ধং দেহি’ মনোভাব থেকে কোনও পক্ষ সরে আসবে কি না, বলা কঠিন। কিন্তু সে ‘যুদ্ধ’ অন্য ভাবে জারি থাক। শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করবে কেন? তবু, একটু হাসি পায়। রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের ‘মর্যাদা’ রক্ষার তাড়নায় আজ সি পি এম কেমন কোমর বেঁধে নেমেছে, দেখে সামান্য অবাক লাগে। এরা সেই দল, যার শীর্ষনেতা জ্যোতি বসু এক দিন দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টি এন শেষনকে ‘পাগলা কুকুর’ (হি ইজ আ ম্যাড ডগ) বলতেও ছাড়েননি। এমনকী, শেষনের ক্ষমতা খর্ব করতে দ্রুত অর্ডিন্যান্স জারি করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওকে রীতিমত চাপ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবাবু। ইতিহাসের সেই পাতাগুলি আজও সজীব!
কে ঠিক, কে ভুল, কার অধিকারের সীমা কত দূর, তা আইনি বিবেচনা এবং রাজনৈতিক তর্কের বিষয়। কিন্তু একটা কথা তো ঠিক যে, আজ রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে পঞ্চায়েত নির্বাচন পরিচালনার বিভিন্ন স্তরে তৃণমূল পরিচালিত রাজ্য সরকারের সঙ্গে যে ভাবে একের পর এক বিবাদে জড়িয়েছেন, তেমনই নব্বইয়ের দশকে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার শেষনকে বার বার আক্রমণ করেছে সে দিনের বাম সরকার। আজ যেমন মীরা বনাম মমতা, সে দিন তেমনই জ্যোতিবাবু আর শেষনের ‘নারদ-নারদ’।
শেষন বলেছিলেন, ১৯৯৫-এর ১ জানুয়ারির মধ্যে সচিত্র ভোটার-পরিচিতি চালু না হলে তিনি ভোট করতে দেবেন না। তার সম্ভাব্যতা কিংবা অন্য সুবিধা-অসুবিধার দিকগুলি আলোচনা করছি না। এ ক্ষেত্রে সেটা প্রাসঙ্গিক নয়। শুধু এটুকুই মনে করিয়ে দিই, সেই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে জ্যোতিবাবু বলেছিলেন, “আমাদের দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার পদে এক জন পাগল বসে রয়েছেন বলেই যত সব ঝামেলা হচ্ছে।”
এর কিছু দিন পর কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে ঘটনাচক্রে একই মঞ্চে বসতে হয় জ্যোতি বসু ও টি এন শেষনকে। শেষন রসিকতার সুরে বলেন, “উদ্যোক্তারা ভেবেছেন, আমাকে ডাকলে হয়তো ভিড় হবে। যেমন, চিড়িয়াখানায় কোনও অদ্ভুত জন্তু দেখতে লোক ভিড় করেন।” এর পরে বসুর মন্তব্য: “উনি কেন এসেছেন, সেটা উনি নিজেই বলে দিলেন।” সৌজন্য ও শালীনতার কোন অভিধানে এক জন সাংবিধানিক পদাধিকারীকে পাগল বলা যায়, কথার মারপ্যাঁচে চিড়িয়াখানার জন্তু বলে ইঙ্গিত করা যায়, আলিমুদ্দিন স্ট্রিট নিশ্চয় তার হদিশ জানে। আর সেখানেই প্রশ্ন, দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সম্পর্কে ওই সব মন্তব্য যাঁদের কাছে বাহবা পেয়েছিল, আজ মীরা পাণ্ডে সম্পর্কে মদন মিত্রদের উক্তি তাঁদের ‘নীতিবোধে’ ঘা মারছে কেন? চালুনি করবে সুচের বিচার!
তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগ আরও। তারা মীরা পাণ্ডের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের কথা তুলছে। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেছেন, “মীরাদেবী পক্ষপাতদুষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তির মতো আচরণ করছেন। রাজ্যকে অশান্ত করার চেষ্টা করছেন।” মুকুলের সতীর্থ সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে অভিহিত করেছেন ‘কমরেড মীরা পাণ্ডে’ বলে। এবং আরও এক বার ছি ছি করে উঠেছে সবাই। সি পি এম-ও। ঠিকই করেছেন। নেতাদের কথাবার্তায় সংযম, সাংবিধানিক পদের প্রতি মর্যাদাবোধ থাকবে না কেন?
কিন্তু ইতিহাস যে বড় নির্মম সাক্ষী! ’৯১-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে শেষনের বিরুদ্ধে ‘ভোট ভন্ডুলের চক্রান্ত’র অভিযোগ তুলেছিল সি পি এম। কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তিনি নাকি চক্রান্ত করেছেন— কয়েকটি জায়গায় কংগ্রেসের নির্বাচনী এজেন্টরা রিগিংয়ের অভিযোগ তুলে বুথ ছেড়ে বেরিয়ে আসবেন এবং ফের ভোট চাইবেন। কিছু প্রিসাইডিং অফিসারকেও কৌশলের শরিক করা হবে। স্বয়ং জ্যোতিবাবু বলেছিলেন, “এ রকম পরিকল্পনার খবর রাজ্য সরকারও পেয়েছে।” শুধু তা-ই নয়, কলকাতা প্রেস ক্লাবে মিট দ্য প্রেস-এ জ্যোতি বসু বলেছিলেন, “শেষন যে সব কথাবার্তা বলছেন, তাতে সমাজবিরোধীরাই উৎসাহিত হবে।” তাঁর আরও বক্তব্য ছিল, “শেষনের কোনও ব্যালান্স নেই। তিনি হাতে মাথা কাটছেন। এমন লোকের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হওয়া উচিত নয়।” আজ মীরা পাণ্ডে সম্পর্কে মমতা ও তাঁর দলবলের কথাবার্তায় আলাদা কোনও স্বর শোনা যাচ্ছে কি? মনে তো হয় না।
আসলে ধারাবাহিক ভাবে এটাই তো আমাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে। ডান-বাম, সি পি এম-তৃণমূল— এ ব্যাপারে কেউ কারও চেয়ে কম যায় না। ‘আকাল’ আমাদের সর্বাঙ্গে। দল বা পতাকার রং আলাদা হলেও রাজনীতির সামগ্রিক অধঃপতন তাই রোধ করা অসম্ভব। এই রাজনীতি কখনও সাংবিধানিক পদাধিকারীকে পায়ের তলায় ফেলতে চাইবে, কখনও হাইকোর্টের জজকে বলবে ‘বাংলা ছেড়ে পালা’, কখনও মিডিয়ার গলা টিপে মারতে চাইবে, কখনও সত্যের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলবে, ‘সব সাজানো’। পরম মমতায় সে সব মণিমাণিক্য আমরা তুলে রাখব প্রজন্মের পর প্রজন্ম। |