ইংল্যান্ডের একটি কাফে-র দ্বারে ইংরাজি ভাষায় এই মর্মে নোটিস লটকাইতে হইল: ‘এতদ্দ্বারা সকলকে অবগত করা যাইতেছে যে, আমি এক জন কৃষ্ণাঙ্গ নারী এবং চির কালই তাহাই থাকিব। আপনার যদি কৃষ্ণাঙ্গ মানুষে অ্যালার্জি থাকে, ভিতরে আসিবেন না। কিন্তু আপনি যদি পরিচ্ছন্ন পরিবেশে সুস্বাদু খাদ্য খাইতে ইচ্ছুক হন, প্রবেশ করুন। আমি দংশন করি না।’ এই লিখন ফেসবুকে আলোড়ন তুলিয়াছে, অনেকেই সমব্যথী হইয়া এবং বর্ণবৈষম্যের বিরোধিতা করিয়া মন্তব্য পোস্ট করিয়াছেন। মহিলা এই নোটিস দিতে বাধ্য হইয়াছেন কারণ বহু মানুষ নাকি দরজা খুলিয়া তাঁহার কাফেতে ঢুকিয়া তাঁহাকে দেখিয়াই তৎক্ষণাৎ বাহির হইয়া যান। ঘটনাটি এই মুহূর্তে সংবাদপত্রের শিরোনাম, হয়তো কাফেটি এই ঘটনার ফলে এমনই বিখ্যাতও হইয়া যাইবে, ব্যবসায় বাড়িবে। এক ভারতীয় অভিনেত্রী ইংরাজি রিয়ালিটি শো-তে অংশ লইয়া এমন কদর্য বর্ণবৈষম্যমূলক মন্তব্য ও আচরণের শিকার হইয়াছিলেন যে তাঁহার বেদনার প্রতি সম্মান ও সমব্যথার তরঙ্গে তিনি ওই শো-র বিজয়িনী হইয়া কেরিয়ারে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হন। কিন্তু এইগুলি ওই অসহ্য অপমানের ক্ষতিপূরণ হইতে পারে না, নোটিসের বোলবোলাও হইলে কাফে-মহিলার হৃদয়ক্ষত শুকাইবে না। এই জঘন্য অসম্মানের ধারা যুগ যুগ ধরিয়া প্রবাহিত হইতেছে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ইহার আঘাত সহিয়া বাঁচিতেছে। কেবল কৃষ্ণাঙ্গরা নহেন, বহু জাতি বহু বর্ণের মানুষ এই অশিক্ষার ভল্লে নিরন্তর জর্জরিত। বিদেশি বিমানবন্দরে প্রায়ই এশীয় (পীতাঙ্গ) মানুষ অযথা অপদস্থ হন, কর্তৃপক্ষ তাঁহাদের প্রতি স্পষ্টতই বৈষম্যমূলক আচরণ করিয়া থাকেন, তাঁহাদের অন্যায় ভাবে তল্লাশি করেন বা মিথ্যা অভিযোগ দর্শাইয়া দীর্ঘ ক্ষণ আটকাইয়া রাখেন। মানব-ট্র্যাজেডি হইল, এই মানুষগুলিও হয়তো নিজ দেশে ফিরিয়া আসিয়া অন্যের প্রতি কর্কশ সাম্প্রদায়িক আচরণ করিয়াছেন।
সাম্প্রদায়িকতা প্রায় নিরাময়হীন এক ব্যাধি, যাহা বিশ্বময় বিষ-দাপট লইয়া ছড়াইয়া আছে। কোনও নেতা যখন সাক্ষাৎকারে তাঁহার কোনও গোষ্ঠীঘৃণার কথা বলিয়া ফেলেন, তাহা লইয়া হইহই হয়, কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রায় প্রতিটি ঘরে প্রতিটি আড্ডায় এমন কিছু কথা উড়িয়া বেড়ায়, যেগুলি অন্য কোনও গোষ্ঠীর প্রতি অত্যন্ত অন্যায় ভাবে প্রযুক্ত। তাহা লইয়া প্রতিবাদ ঘটে না। একটি ধর্মাবলম্বী গৃহে অপর ধর্মাবলম্বীদের সম্পর্কে প্রায়ই ইতর মন্তব্য করা হয়; সেই ধর্মের মানুষের আচরণও অবিকল অনুরূপ, কেবল পক্ষ পালটাইয়া যায়। কলিকাতার বহু মানুষ পথে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ দেখিলে মহা কৌতুকে উঁহাদের সম্পর্কে কুরুচিকর মন্তব্য ভাসাইয়া দেন। মেট্রোয় গ্রাম্য মানুষের দল উঠিয়া কিছুই ঠাহর করিতে পারিতেছেন না, দেখিয়া শহুরে বাবুবিবি সেই কামরায় না উঠিয়া হাসি ও বিরক্তি চাপিয়া অন্যত্র চলিয়া যান। সমকামীদের ভেঙাইয়া হিজড়েদের ভেঙাইয়া সকল জমায়েতেই বাহবা লাভ করা যায়। পুরুষ-প্যাসেঞ্জাররা বাসেট্রামে মহিলার সহিত কলহ হইলে উচ্চ স্বরে নারীজাতি সম্পর্কে অবমাননাকর কথা প্রচার করেন। যে স্থানে যে সংখ্যাগুরু, সেই স্থানে সে সংখ্যালঘুকে হেনস্থা করিতে প্রস্তুত থাকে। অনেকে প্রত্যক্ষ ভাবে এমন আচরণ না করিলেও, বেরসিক (বা প্রতিবাদ করিয়া সংখ্যালঘু) প্রমাণিত হইবার ভয়ে এই অনুষ্ঠানকে বিঘ্নিত করেন না। তবে কি মার্টিন লুথার কিং বা আব্রাহাম লিংকন নিতান্ত অবান্তর যুদ্ধে প্রাণ দিলেন? তবে কি এত মানুষের এত সংগ্রাম ও মনীষা ব্যয়ের পরে আমাদের হাতে থাকিল কেবল কিছু শ্লেষ ও কিছু আত্ম-পরিহাস মিশ্রিত এক নোটিস? |