উদ্যোগী বেসরকারি হাসপাতালও
সামাজিক দায় মেটাতে দুঃস্থদের পরিষেবা
কাজের সূত্রে শহরে এলে দূর থেকে ঝাঁ-চকচকে হাসপাতালগুলো দেখতেন হামিদ শেখ। ভাবতেন, তাঁর রুগ্ন ছেলেটার যদি এমন কোথাও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যেত! কিন্তু পেশায় ঢালাই মিস্ত্রির পক্ষে এমন চিন্তার জন্যও সাহস লাগে। হামিদ জানতেন, জন্ম থেকে হার্টের অসুখে ভোগা তাঁর ১০ বছরের ছেলেটা তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু পরিস্থিতিটা ঘুরল পশ্চিম মেদিনীপুরে তাঁদের গ্রামে একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা ক্যাম্প করতে আসার পরে। হামিদের স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন। ওই হাসপাতালের তরফে তাঁর ছেলের নিখরচায় অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা হয়।
‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি’ বা সংক্ষেপে সিএসআর। মুনাফা বাড়ানোর পাশাপাশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলির সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি ইদানীং নানা স্তরে গুরুত্ব পাচ্ছে। বিশেষত স্বাস্থ্য প্রকল্পে এগিয়ে আসছেন অনেকেই। কখনও ক্যাম্প চালু করে, কখনও সরকারি হাসপাতাল থেকে পাঠানো রোগীদের নিখরচায় চিকিৎসা করে, কখনও আবার প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে গরিব রোগীদের স্বাস্থ্য পরিষেবা দিচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালগুলো। রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে দীর্ঘ দিন যুক্ত এমন অনেকেই মনে করছেন, এই পদক্ষেপ রাজ্যের পক্ষে সামগ্রিক বিচারে ইতিবাচক। কারণ পরিষেবার নানা গলদের পাশাপাশি বিপুল রোগীর চাপ রয়েছে সরকারি হাসপাতালগুলির উপরে। সে কারণে বেসরকারি হাসপাতালগুলির নানা উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছে রাজ্য সরকারও।
স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার কথায়, “এসএসকেএম হাসপাতালে বা অন্য কোনও সরকারি প্রতিষ্ঠানে ইকো-কার্ডিওগ্রাফি বা ওই জাতীয় পরীক্ষা করাতে গেলে যেখানে এক বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে, সেখানে যদি কেউ নিখরচায় বা ন্যূনতম খরচে ওই পরীক্ষা করে দেয়, তার থেকে ভাল আর কী হতে পারে? সরকারি তরফেও এমন উদ্যোগকে আমরা নানা ভাবে উৎসাহিত করার কথা ভাবছি।”
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রেই বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতালের এমন নানা কাজের খতিয়ান মিলেছে। যেমন, বছরে প্রায় ২৫০ স্বাস্থ্যশিবির করে দুর্গাপুরের মিশন হাসপাতাল। জঙ্গলমহল থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রাম, সর্বত্রই। চিকিৎসকরা পরীক্ষা তো করেনই। পাশাপাশি বিনা পয়সায় রক্ত পরীক্ষা, ইসিজি, এমনকী ইকো-কার্ডিওগ্রাফিও হয়। পোর্টেবল ইকো যন্ত্র নিয়ে টেকনিশিয়ানরা পৌঁছে যান প্রত্যন্ত গ্রামে। হাসপাতালের চেয়ারম্যান সত্যজিৎ বসু বলেন, “আমাদের দায়িত্বটা এখানেই শেষ হয়ে যায় না। ওই সব ক্যাম্পে ১২ বছরের কম বয়সী যে সব ছেলেমেয়ের জন্মগত হার্টের সমস্যা ধরা পড়ে, তাদের বিনামূল্যে অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করি আমরা।”
মধ্য কলকাতার বেলভিউ ক্লিনিক আবার স্বাস্থ্য শিবিরের পাশাপাশি আর্সেনিক নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। বিভিন্ন জেলায় গ্রামে ঘুরে জলের নমুনা পরীক্ষা করেন চিকিৎসক-গবেষকরা। এলাকার মানুষের রক্ত পরীক্ষা হয়। নার্সিংহোমের সিইও প্রদীপ টন্ডন বলেন, “রক্ত পরীক্ষায় আর্সেনিক সংক্রমণ ধরা পড়লে নিখরচায় চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গরিব মানুষই এতে আক্রান্ত হন। তাই আমরা তাঁদের পাশে দাঁড়াতে চাই।”
ই এম বাইপাসের মেডিকা হাসপাতাল সম্প্রতি বিভিন্ন পেশার এক কালের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব, অধুনা যাঁরা আর্থিক সমস্যায় রয়েছেন, তাঁদের চিকিৎসার ভার নিয়েছে। প্রকল্পের নাম ‘আপনজন’। চলতি বছরেই খেলোয়াড়, অভিনেত্রী, চিত্রগ্রাহক-সহ মোট ১০ জনের চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বস্তি এলাকায় রোগ নির্ণয় ক্যাম্প চালু করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওই হাসপাতাল। হাসপাতালের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান কুণাল সরকার বলেন, “ডায়াবিটিস, হার্টের সমস্যা, ফুসফুসের সংক্রমণ সহজেই নির্ণয় করা যায়। গরিব মানুষ আর্থিক কারণে সেটা পারেন না। অথচ শহরের বস্তিগুলি ঘুরলে বোঝা যায়, সেখানকার বাসিন্দাদের একটা বড় অংশ এই সমস্যায় আক্রান্ত।”
বেলেঘাটার অ্যাপোলো হাসপাতালের সিইও রূপালি বসু জানিয়েছেন, তাঁদের দুটি মোবাইল মেডিক্যাল ইউনিট রয়েছে। উত্তর ২৪ পরগণার সাতটি গ্রামে তারা পরিষেবা দেয়। এর মধ্যে একটি ইউনিটে ক্যানসার নির্ণয় হয়। ইতিমধ্যেই নিখরচায় ২২ হাজার জনের ক্যানসার নির্ণয় করেছেন তাঁরা।
শুধু বেসরকারি হাসপাতাল নয়, স্বাস্থ্য পরিষেবায় এগিয়ে আসছে বিভিন্ন শিল্পসংস্থাও। শালবনিতে জিন্দলদের ইস্পাত প্রকল্পের ভবিষ্যৎ যা-ই হোক না কেন, আশপাশের ২৩টি গ্রামের মানুষদের চিকিৎসার ভরসা এখন জিন্দলদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রই। জামবেদিয়া, আসানসুলি, কুলফেনি, চন্দনকাঠ, বানঘুটু, বরজু-সহ বেশ কিছু গ্রামে যেখানে বাসিন্দাদের কাছ থেকে জমি নেওয়া হয়েছিল, তাঁদের চিকিৎসা পরিষেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তোলার পাশাপাশি চলছে অকুপেশনাল হেলথ সেন্টার-ও। ১৪ থেকে ৪০ বছরের মহিলাদের রক্তাল্পতা মাপার কাজ শুরু হয়েছে। প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা জয়মাল্য হালদার বলেন, “অপুষ্টি নিয়েও কাজ চলছে। বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, কৃমিই হল অপুষ্টির বড় কারণ। সেই বিষয়ে লাগাতার সচেতনতা কর্মসূচি চালানো হচ্ছে।”
বিপণন বিশেষজ্ঞরা অবশ্য মনে করছেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলোর কাছে ব্যবসা বাড়ানোর এটাও একটা নয়া পন্থা। বিজ্ঞাপনের জন্য যেমন একটা মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয়, সিএসআর-এর মাধ্যমেও নিজেদের বিজ্ঞাপিত করার কাজটা করা যায় সুচারু ভাবেই। সঙ্গে সমাজসেবার মোড়কটাও থাকে। তাতে পরবর্তী সময়ে সরকারের কাছেও নানা ছাড়ের ব্যাপারে আবেদন করা যায়। কিন্তু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য যদি থেকেও থাকে, নিট ফল হিসেবে কয়েক জন হামিদ শেখের সন্তান যদি চিকিৎসা পায়, সেটা কম নয়। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে যেখানে রোগীর চাপ সামলানো সরকারি পরিকাঠামোয় কার্যত অসম্ভব, সেখানে এমন উদ্যোগের সংখ্যাবৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি বলেই মনে করছেন তাঁরা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.