|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
জোরটা দারিদ্র ও অসাম্যের উপরেই |
অচিন চক্রবর্তী |
অ্যান আনসাটর্ন গ্লোরি/ ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইট্স কন্ট্রাডিকশনস,
জঁ দ্রেজ ও অমর্ত্য সেন। পেঙ্গুইন/অ্যালেন লেন, ৬৯৯.০০ |
গত শতকে একটা লম্বা সময় ধরে জাপানের আর্থনীতিক অগ্রগতির সঙ্গে মানবজাতি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। তার পর ষাটের দশকের শেষ থেকে পূর্ব এশিয়ার চারটি দেশ: দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর ও হংকং তৃতীয় বিশ্বের তকমা শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলতে শুরু করল দ্রুত লয়ে। ১৯৭৮ থেকে উঠে দাঁড়াল চিন। ক্ষিপ্রতায় রেকর্ড গড়ে ফেলল, বৃদ্ধির হার নিয়ে গেল দশের উপর। দক্ষিণ এশিয়া, মূলত ভারত, এল অনেক পরে। দু’দশক আগেও কে ভাবতে পেরেছিল ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধির হার চড়তে চড়তে প্রায় নয় শতাংশ ছুঁয়ে ফেলবে? অতি সম্প্রতি অবশ্য তা নেমে এসেছে পাঁচে। আর তা নিয়ে সরকারি মহলে, সংবাদমাধ্যমে উদ্বেগও কম দেখা যায়নি।
ভারতীয় অর্থনীতির এই অভাবনীয় উত্থান এক পুলকমিশ্রিত জাতীয়তাবাদী উদযাপনের মনোভাব উসকে দেয়, অন্তত এক শ্রেণির ভারতবাসীর মধ্যে, যাঁদের এক কথায় ‘এলিট’ বলা যায়। সিলিকন ভ্যালি-পূর্ববর্তী ভারত নিয়ে বিদেশিদের নিদারুণ অনাগ্রহে যারপরনাই মুষড়ে থাকতেন এঁরা। বাবুদের লজ্জা হত। ‘উদীয়মান ভারত’ ‘বলীয়ান ভারত’ ঘিরে প্রথম বিশ্বের আগ্রহে তাঁরা তৃপ্ত।
বিশ্বরঙ্গমঞ্চে ভারতীয় অর্থনীতির তাল ঠুকে আবির্ভাব নিয়ে গত এক দশকে বেশ কয়েকটি বই লেখা হয়েছে। বিমানবন্দরের বিপণিতেও তারা শোভা পায়। অরবিন্দ ভিরমানির দু’খণ্ডে প্রপেলিং ইন্ডিয়া, রফিক দোসানির ইন্ডিয়া অ্যারাইভিং, স্টিফেন কোহেন-এর ইন্ডিয়া: এমার্জিং পাওয়ার, এডোয়ার্ড লিউইস-এর ইন স্পাইট অব গডস: দ্য স্ট্রেঞ্জ রাইজ অব মডার্ন ইন্ডিয়া। শিরোনাম থেকেই বোঝা যায়, মূল ঝোঁকটি উদযাপনমূলক।
জঁ দ্রেজ ও অমর্ত্য সেনের বইটি এ-ধারার সম্পূর্ণ বিপরীতে। এঁদের রচনার সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা হয়তো অনেকটাই আন্দাজ করতে পারবেন কী থাকতে পারে এই বইয়ে। ভারতকে শিরোনামে রেখে তাঁদের প্রথম বই ইন্ডিয়া: ইকনমিক ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সোশাল অপরচুনিটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৫-এ। তার পর ২০০২-এ ইন্ডিয়া: ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পার্টিসিপেশন। এগারো বছরের ব্যবধানে তাঁদের যৌথ শ্রমের ফসল এই তৃতীয়। ’৯৫-এ বলশালী ভারতের আবির্ভাব ঘটেনি। দারিদ্র, অসাম্যের বহুরূপ, মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলির নিদারুণ অপ্রতুলতা, রাষ্ট্রের কাছে কোন বিষয়টি প্রভূত গুরুত্ব পাওয়া উচিত ছিল কিন্তু পায়নি— এ সবই ছিল প্রথম বইয়ের বিষয়। এখন পরিপ্রেক্ষিত বদলেছে। প্রায় সিকি শতাব্দী জুড়ে অর্থনীতির স্ফীতি হয়েছে যে হারে, তা অধিকাংশ দেশই স্বপ্নেও আনতে পারে না। অথচ সরকারি মাপক অনুসারেই প্রায় ত্রিশ কোটি ভারতবাসী দারিদ্র সীমার নীচে। ফলত, দ্রেজ এবং সেনের মূল সুরটির বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি। ঘটার কারণ নেই। অমর্ত্য সেন বলে থাকেন, ‘আমাকে অনেকেই অনুযোগ করেন, আপনি এক কথা বার বার বলেন কেন? আমি বলি, কারও ক্যানসার হলে তাকে বার বার চিকিৎসা করার কথা না বলে অন্য আর কী কথা বলা যেতে পারে আমি জানি না।’ যে বইগুলোর কথা গোড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন ভিরমানির, সেখানে কিন্তু দারিদ্র ও অসাম্য নিয়ে যৎসামান্য কালি খরচ করা হয়েছে। অথচ প্রশ্ন হল, এমন ক’টা দেশ আছে, যেখানে আড়াই দশক ধরে অর্থনীতি বেড়েছে ৫-৭ শতাংশ হারে, অথচ দারিদ্র কমেছে এমন শম্বুকগতিতে? জীবনযাপনের জন্য জরুরি ন্যূনতম পরিষেবাও ব্যাপক সংখ্যক অধিবাসীর অনায়ত্ত?
২০১১-র জনগণনা থেকে জানা যায়, ভারতে অন্তত অর্ধেক মানুষের শৌচালয় ব্যবহারের সুযোগ নেই। বাংলাদেশে সংখ্যাটা দশ শতাংশের কম। শৌচালয়ের ব্যবস্থা করতে কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নয় শতাংশ হারে বাড়তে হয়নি। ভারতে উচ্চকোটির সঙ্গে নিম্নবর্গের অসাম্যকে শুধু আয়-বৈষম্যের চালু সূচক (যেমন জিনি সূচক) দিয়ে ধরা যাবে না। জিনি সূচক অনুসারে ভারতে ব্যক্তিগত আয়ের বৈষম্য চিন বা ব্রাজিলের থেকে কম। গত দু’দশকে যে তা সাংঘাতিক রকম বেড়েছে, তা-ও বলা যায় না। কিন্তু এ দেশে বৈষম্যের তীব্রতা অনেক বেশি, কারণ বিশাল সংখ্যক মানুষের জীবনে ন্যূনতম পরিষেবাও আয়ত্তের মধ্যে নেই, কারণ রাষ্ট্র এ বাবদে ব্যর্থ। আর এলিট ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির এ বিষয়ে নির্লিপ্ত সহিষ্ণুতা। এই নির্লিপ্ত সহিষ্ণুতা নিয়ে দ্রেজ ও সেন এ বইয়েও আমাদের খুঁচিয়েছেন। শেষ অধ্যায়ের শিরোনামটিই হল ‘অসহিষ্ণু হওয়ার প্রয়োজনীয়তা’। তাঁরা স্বীকার করছেন, অসহিষ্ণু আমরা হচ্ছি না তা নয়। গত জুলাইয়ে এক দিন দেশের প্রায় অর্ধেক অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল। গোটা দেশের মানুষ প্রশাসনিক ব্যর্থতা নিয়ে চরম উত্তেজনায় ফেটে পড়েছিল। স্বাভাবিক। কিন্তু দেশের কুড়ি কোটি মানুষের ঘরে যে সারা বছরই বিদ্যুৎ নেই, এটা কি আমাদের একটুও উত্তেজিত করে? কুড়ি কোটি কিন্তু ওই অর্ধেকের এক-তৃতীয়াংশ। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত অধ্যুষিত নাগরিক সমাজের ক্ষোভ, উত্তেজনা, স্বতঃস্ফূতর্ আন্দোলনের সিংহভাগই যে মধ্যবিত্ত সমাজেরই সমস্যা ঘিরে, এটি তাঁরা বার বারই মনে করিয়ে দেন।
আমরা দেখেছি, ডান-বাম নির্বিশেষে রাজনৈতিক দলগুলি ‘সাধারণ মানুষ’-এর কথা ভেবে পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়ার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে পড়ে। তাদের শুনতে ভাল লাগবে না, এই সক্রিয়তাকে দ্রেজ এবং সেন সুবিধাভোগী সরকারি কর্মচারীদের মাইনে বাড়ানোর আন্দোলনের একগোত্রে ফেলে কটাক্ষ করেছেন।
রাষ্ট্রের যে ব্যর্থতার কথা লেখকদ্বয় বিস্তারিত ভাবে কয়েকটি অধ্যায়ে বলেছেন, তাতে ফলিত গবেষণালব্ধ জ্ঞানের ব্যবহার শিক্ষণীয়। এই জ্ঞানটুকু বাদ দিয়ে যদি শুধুই নৈতিকতা-উৎসারিত সমালোচনায় আটকে থাকলে এক ধরনের হতাশাব্যঞ্জক উপসংহারে সহজেই উপনীত হওয়ার প্রবণতা থাকে— এ দেশে কিস্যু হবে না। দ্রেজ এবং সেন কখনও সে পথে যান না। ব্যর্থতার সূক্ষ্ম কাটাছেঁড়া করে তাঁরা চলে যান ভারতীয় গণতন্ত্রের স্বরূপ বিশ্লেষণে, যেখানে তার দুর্বলতার দিকটিও চিহ্নিত করেন, জোরের দিকটিও। যেমন ধরা যাক এই পর্যবেক্ষণটি। ছত্তীসগঢ়ের সরগুজা জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রাম ঝাপর। লেখকদ্বয়ের এক জন, সম্ভবত দ্রেজ, ২০০১-এ যখন সেখানে যান, এক আদিবাসী মহিলা ক্ষোভে হতাশায় তাঁকে বলেন, ‘আমাদের কথা কেউ শোনে না, আমরা তো আর ডান্ডা নিয়ে ঝাঁপাতে পারি না।’ তাঁর ক্ষোভ গণবণ্টন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। রেশন দোকান পায়ে হেঁটে তিন ঘণ্টার পথ। এর সঙ্গে নানাবিধ অন্য সমস্যা তাঁদের কাছে এই ব্যবস্থাকে অবান্তর করে তুলেছিল। ২০১২-য় যখন আবার গেলেন জঁ, অবাক হলেন। গ্রামেই রেশন দোকান, গ্রামেরই লোকজন চালাচ্ছেন। প্রায় সকলেরই রেশন কার্ড রয়েছে, এবং তাঁদের কোটার ৩৫ কিলো চালই সবাই পাচ্ছেন, অতি অল্প দামে, মাসের গোড়াতেই।
এই পরিবর্তনটি যে শুধু সরকারি যন্ত্রের মানবিকতা বা সদিচ্ছার ফলে হয়েছে, তা তো নয়। এখানেই আসে গণ-সক্রিয়তার গুরুত্বের প্রশ্নটি। স্বাস্থ্য, শিক্ষা কিংবা খাদ্য সুরক্ষায় সরকার না বাজার— এই নিয়ে যখন বিতর্ক চলে, অনেকে বলেন, এগুলি যেহেতু মানুষের ‘মৌলিক’ অধিকারের মধ্যে পড়ে, সরকারকেই এর জোগান দিতে হবে। অমর্ত্য সেন কিন্তু আইন করে অধিকারের স্বীকৃতির অপেক্ষায় থাকতে রাজি নন। আইন নেই বলে অধিকারের নৈতিক দিকটিও স্বীকার করা হবে না— এই সম্ভাবনার কথা ভেবেই অধিকারের নৈতিক জোরের দিকটি নিয়েই তিনি বার বার বলেন, আইন থাক বা না-থাক। কিন্তু কেন সরকারকেই স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতে হবে তার অন্য যুক্তিও আনেন, গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে। যেমন, গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যদি ফি সামান্য বাড়ানো হয়, অনেক মানুষই আর পরিষেবার সুযোগ নেন না বা নিতে পারেন না। বোঝাই যায়, ফি-ভিত্তিক অসরকারি পরিষেবার প্রসারের ফলে কত মানুষ সুযোগ-বঞ্চিত হতে পারেন।
তবে গবেষণালব্ধ ফলের যথাযথ ব্যবহারে লেখকদ্বয় যে সর্বদা নিষ্পক্ষ থাকতে পেরেছেন, তা নয়। যেমন, জনসংখ্যায় নারী-পুরুষের অনুপাত প্রসঙ্গ। ছ’বছর বা তার নীচের শিশুদের মধ্যে মেয়ে এবং ছেলের অনুপাত থেকে লিঙ্গ-বৈষম্যের আন্দাজ পাওয়া যায়। ভারতে অনুপাতটি গত এক দশকে কমেছে। ২০০১-এ প্রতি হাজার ছেলের জন্যে মেয়ের সংখ্যা ছিল ৯২৭, ২০১১-য় তা নেমে এসেছে ৯১৪-তে। রাজ্যগুলির দিকে দেখলে এর একটা প্রায়-স্পষ্ট প্যাটার্ন পাওয়া যায়। সাধারণত উত্তর ও পশ্চিম দিকের রাজ্যগুলিতে এই অনুপাত দক্ষিণ ও পূর্ব দিকের রাজ্যগুলির তুলনায় কম। বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতি তথা কন্যাসন্তান সম্পর্কে মানুষজনের মনোভাব বিষয়ে খানিক পূর্বধারণার সঙ্গে এই তথ্য যেহেতু অনেকটাই মিলে যায়, লিঙ্গ-বৈষম্যের দিক থেকে খারাপ বা ভাল অবস্থায় থাকা রাজ্যগুলিকে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু মেয়ে ও ছেলের সংখ্যার অনুপাত এবং তার বাড়া-কমা থেকে কন্যাভ্রূণ হত্যা বিষয়ে কোনও নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা যায় কি? অষ্টম অধ্যায়ে লিঙ্গ-বৈষম্য বিষয়ে আলোচনায় তাঁরা কন্যাভ্রূণ হত্যা প্রসঙ্গটি এমন ভাবে উল্লেখ করেন যে, মনে হয় লিঙ্গ অনুপাতের বিভিন্নতার একমাত্র কারণ বিভিন্ন রাজ্যে কন্যাভ্রূণ হত্যার প্রবণতার কম-বেশি। গবেষণা বলছে, লিঙ্গ অনুপাতের হ্রাসের কারণ একাধিক হতে পারে। একটির কথা বলি। মাতৃগর্ভে ভ্রূণ অবস্থায় ছেলের সংখ্যা মেয়েদের তুলনায় অনেকটা বেশি। কিন্তু, পুরুষ-ভ্রূণ নারী-ভ্রূণের তুলনায় কমজোরি হওয়ায় জন্মমুহূর্তে লিঙ্গ অনুপাত অনেকটা মেয়েদের দিকে ঝুঁকে আসে, কারণ পুরুষ-ভ্রূণ নষ্ট হয় বেশি। সাধারণ ভাবে গর্ভবতীর সুস্বাস্থ্যের সঙ্গে ভ্রূণ অপচয়ের সম্পর্ক রয়েছে— অর্থাৎ, উন্নত স্বাস্থ্যের গর্ভবতীর ভ্রূণ অপচয় কম হবে। এ বার, গর্ভবতীদের গড় স্বাস্থ্যের যদি উন্নতি হতে থাকে, তা হলে ভ্রূণ অপচয় কমতে থাকবে। আর অপচয়ের অধিকাংশ যেহেতু পুরুষ-ভ্রূণ ছিল, সদ্যোজাতদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বাড়বে। এমন নানাবিধ ব্যাখ্যা ও যুক্তিকে গবেষকরা খতিয়ে দেখেছেন। দ্রেজ ও সেন কিন্তু কন্যাভ্রূণ হত্যাকেই লিঙ্গ অনুপাত হ্রাসের একমাত্র কারণ হিসেবে নির্দেশ করেছেন। এই সমালোচনাটুকু বুক ঠুকে করে ফেললাম, কারণ তর্কশীলতার পাঠ তো অধ্যাপক সেনের থেকেই নিয়েছি। তিনিই শিখিয়েছেন, আবেগ ও যৌক্তিকতার মধ্যে অনপনেয় কোনও সংঘাত নেই। আমাদের নির্লিপ্ত সহিষ্ণুতার পাথর ভাঙতে আবেগ ও যুক্তির মিশেল কতটা, কী ভাবে হবে, তা এত ভাল ভাবে আর কে বলতে পারেন? |
|
|
|
|
|