হাঁড়ির খবর
মিঠে-কড়া মৌতাত
ঙুরের রক্ত দিয়ে তৈরি শৌখিন, ফুরফুরে ওয়াইনকে ‘মদ’ বলে ডাকায় তাঁর ঘোর আপত্তি জানিয়েছিলেন রাধাপ্রসাদ গুপ্ত ওরফে শাঁটুলবাবু। দেশ পত্রিকার একটি পুরনো নিবন্ধে লিখেওছিলেন, অমন মদিরাকে মদ বললে তা কোনও অতীব রূপবতী, গুণবতী তরুণীকে একটি অপশব্দ বলার মতো গর্হিত কাজ হবে। কদাচিৎ উঁচু জাতের কোনও প্রখরতর তরল চাখতে বসেও তাকে মদ বলে ডাকাটা বড্ড কানে লাগে।
ফরাসিমুলুক থেকে এ শহরে হাজির চৌকস মিক্সোলজিস্ট উলরিখ নিসের সঙ্গে ভদকা নিয়ে বসলেও এমনটাই মনে হতে বাধ্য। আপনার বরাবরের অভ্যেসমতো ভদকায় লেবুস্বাদের নরম পানীয় ঢকঢকিয়ে মেশাতে দেখলে উলরিখ তিরবিদ্ধ হওয়ার মতোই বুকে হাত চেপে চেয়ার থেকে প্রায় পড়ে যাবেন। এমন অধর্মের কথা শুনেই কানে হাত চেপে ‘তওবা তওবা’ বলে তিনি শেখাবেন, যথার্থ রসিকসিংহ (কিংবা সিংহী) না কি সুপ্রাচীন স্কচের মতো ভদকাও স্রেফ বরফে ঢেলেই খাবেন।
উলরিখের ভদকা অবশ্য যে-সে ভদকা নয়। এ যাত্রা ব্র্যান্ডি-ওয়াইন খ্যাত কনিয়াক অঞ্চলের ভদকা তিগর ব্লাঁ নিয়ে এ শহরে এসেছিলেন তিনি। তিগর ব্লাঁ মানে সাদা বাঘ। তা কোন ভদকা যথার্থ বাঘ আর কে নিছকই বেড়াল, তা না কি শুধুমুদু বিনা ভেজাল মিশিয়ে চাখলেই প্রমাণ হবে বলে উলরিখ শুনিয়ে দিলেন। আর তার পরে সাদা বাঘের বোতল থেকে ঢেলে একেবারে নিট পানীয় চেখে দেখার উপদেশ জারি হল। খাঁটি ভদকা খেতে হবে ঢকঢকিয়ে নয়, একটু-একটু করে, ঢুকঢুকিয়ে। জিভে গড়িয়ে, ঠোঁট ভিজিয়ে। ভাল জাতের ভদকা হলে তার কড়া স্বাদে ব্রহ্মতালু জ্বলবে না, অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসবে না। বরং বার বার পরিশোধিত, উঁচু জাতের ভদকা অন্য কিছু না-মিশিয়েই পাহাড়ি ঝর্নার মতো অবাধ গলা দিয়ে নামবে। এতদিন কলকাতায় যে-সব নামী-দামি ভদকা মেলে তাদের মধ্যে অ্যাবসলিউট বা গ্রে গুজ-এর ভক্তেরাও অনেকটা এই ভাবেই ভদকা-সেবনে অভ্যস্ত। ফ্রান্সের কনিয়াক থেকে কলকাতায় হাজির তিগর ব্লাঁ-ও বহু বছর ধরে ওই তল্লাটের এক ওয়াইন-শিল্পী ফ্রাঁসোয়া বেলভিলের পারিবারিক শোধনাগারেই (ডিস্টিলারি) আটকে ছিল। তার কদর ছিল একেবারে স্থানীয় স্তরে। এ বার সেই ভদকাই ব্র্যান্ড হয়ে উঠছে। উলরিখ বলছিলেন, কনিয়াক অঞ্চলের গম আর পন্স শহরের জল এই ভদকার আসল শক্তি। এও ফরাসি সংস্কৃতির একটা অচেনা আবিষ্কার। মৃদু চুমুকের পরে কড়া বিস্বাদ নয়, মুখে একটা হাল্কা মিষ্টি স্বাদও থেকে যায়।
ককটেল-বিলাসীদের অবশ্য একেবারে নিরাশ করছেন না উলরিখ। তিগর ব্লাঁ কলকাতার বাজারে ঢুকতেই তাজ বেঙ্গলে বাঘের সঙ্গে টক্করের বেশ কয়েকটি অস্ত্রও তিনি উপুড় করেছেন।
সাদা বাঘের সঙ্গে মৌরিগন্ধী অ্যাবসিন্থ লিকিওর, কমলালেবুর খোসার গন্ধ, তরমুজের ফ্লেভারে মাত করে দিচ্ছেন। তাঁর হাতযশে কিছু চেনা ককটেলও অতি বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে।
গুরুচণ্ডালী মধুময় দার্জিলিংয়ের গ্লেনারিজের লিকার-ভরা চকোলেট খেতে খেতে বাঙালি সেই কবে থেকে দুঃখু করে আসছে। কলকাতার মার্কামারা সন্দেশ-রসগোল্লায় কেন এমন ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ হয় না। নকুড়ের সদ্য-প্রয়াত মেজবাবু প্রশান্ত নন্দী বিষয়টা নিয়ে ভেবেছিলেন। তবে জগন্নাথদেবের ছবি-সাজানো দোকানে সে-কাজ কখনও করেননি। কিন্তু নিজের ঘরে একেবারে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের আপ্যায়নে সুরা ও সন্দেশ নিয়ে নানা নিরীক্ষা জমে উঠেছিল। চকোলেট সন্দেশের সঙ্গে রাম, সাদা সন্দেশের সঙ্গে ভ্যানিলাগন্ধী ভদকার সঙ্গত ভাল হয়, এই তত্ত্বটা প্রথম প্রশান্তদা-র মুখেই শোনা। এক বার ছানার পায়েসে শ্যাম্পেন মিশিয়ে কেমন হয়েছে চেখে দেখার নেমন্তন্ন করেছিলেন। কী একটা কাজে সেই অনুরোধ রাখতে না-পারার কথা ভাবলে এখনও বড়ই আফশোস হয়। সেক্টর ফাইভের শিমার্স লাউঞ্জ রেস্তোরাঁ সম্প্রতি এমন অনেক আফশোস মিটিয়ে দিতে মাঠে নেমেছে। ইয়াব্বড় রাজভোগের জন্য রাম-মেশানো বিশেষ চকোলেট সসের ব্যবস্থা সেখানে। ভ্যানিলাগন্ধী আইসক্রিম, রকমারি বাদাম, চকোলেট সস ও সাদা রামের মিশেলে ডুব-ডুবু রাজভোগ খেয়েও নেশা করা যেতে পারে। কিংবা আম ও রাম একসঙ্গে চাখতে শিমার্সের অভিনব আমক্ষীরও চমৎকার। সকাল-সন্ধে যখন খুশি আদেশ করলেই সুদৃশ্য শ্যাম্পেন টিউলিপের আধারে তা হাজির হবে। দুধেল আমে রামের মোচড়ে একটু বাদেই ঝিম ধরবে। বেলিজ লিকিওরের অভিঘাতে কাঠবাদামের পায়েসটাও তেজিয়ান হয়েছে।
কিছু পশ্চিমী মিষ্টি-নোনতায় অ্যালকোহলের প্রয়োগও শিমার্সে শিল্পিত। কফিগন্ধী কাহলুয়া লিকিওর দিয়ে চকোলেট মুস বা কমলাগন্ধী কোয়াঁত্র লিকিওরে উদ্দীপিত চিজ বল ভালই লাগে। কোনও কোনও বিশুদ্ধ সুরারসিক অবশ্য এ সব গুরুচণ্ডালী ছেলেমানুষি ভেবে থাকেন। কিন্তু মিষ্টিখোরদের আমেজ গাঢ় করার জন্য এমন তুকতাক অব্যর্থ সন্দেহ নেই।

উপকরণ: একটি লেবুর রস, পাত্রের দু’ভাগ ক্র্যানবেরি জুস, একটু অরেঞ্জ ফ্লাওয়ার কনিয়াক, দু’ভাগ ভদকা, এক ভাগ গ্র্যান্ড মারনিয়ের লিকিওর।
প্রণালী: বরফে ফেলে ভাল ভাবে মেশান। গেলাসে ছেঁকে নিন। উপরে কমলালেবুর খোসার রস সামান্য ছিটিয়ে নিন।

ছবি: শুভেন্দু চাকী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.