ব্যাগ গুছিয়ে... অরণ্যের দিনরাত্রি
ড়ির কাঁটায় সকাল ন’টা তিরিশ। কলকাতা-আগরতলা ফ্লাইট মাটিতে পা ছোঁয়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমার এ বারের লক্ষ্য দক্ষিণ-পশ্চিম ত্রিপুরার তিনটে জঙ্গল। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় প্রিন্সিপাল চিফ কনজারভেটর অফ ফরেস্ট (পিসিসিএফ)-এর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে জঙ্গল ঘোরার উদ্দেশ্য জানাতে মিলল অনুমতি। থাকার জায়গা ঠিক হল সিপাহিজলা, তৃষ্ণা আর বসুন্ধরায়।
কাঁটায় কাঁটায় সকাল সাতটা। গাড়ি হাজির। সারথি বিপ্লব। রওনা দিল গাড়ি। কালো অ্যাসফল্টের রাস্তা সরে সরে যায়। আগরতলা থেকে প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে গাড়ি থামল ‘ক্লাউডেড লেপার্ড ন্যাশনাল পার্ক’-এর সদর দরজায়। ৫.৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই পার্ক সিপাহিজলার অংশ, যার আয়তন ১৮.৫ বর্গকিলোমিটার।
এ জঙ্গলে শাল, বাঁশ, রবার, জাম, ক্যানন বল গাছের বাড়বাড়ন্ত। জলাশয় শান্ত। একটা ভীমরাজ (র্যাকেট টেইলড ড্রংগো) ডেকে চলেছে থেকে থেকে। জলার বুকে নীলচে-বেগুনি শালুক ফুটে আছে। পাড় ঘেঁষে জল থেকে ওঠা গাছটার শিকড়ে বসে ‘লেসার হুইসলিং টিল’-দের (সরল হাঁস) একটা ছোট্ট দল। পানকৌড়িটা পাখা মেলল। সূর্যের আলো পিছলে যাচ্ছে তার চকচকে কালো মসৃণ পালকের উপর দিয়ে। এক ঝাঁক জঙ্গুলে টিয়া ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে। বড় বড় শালের দল পাতার ক্যানোপি তৈরি করেছে। হঠাৎ নজরে এল একদল মুলি বাঁদর (পিগটেইলড ম্যাকা)। ওদের দুষ্টুমি ক্যামেরাবন্দি করে পা ফেলি সামনের জঙ্গলে।
কিছুটা এগোতেই মাথার উপর গাছে ঝুপঝাপ শব্দ। চোখ তুলে তাকাই। ত্রিপুরার বিখ্যাত লুপ্তপ্রায় চশমা-বাঁদরদের (স্পেক্টাকল মাংকি) এক সদস্যের দর্শন। ঠিক যেন জোকার। মাথার চুলগুলো দেখলে মনে হয়, হয় মা চুলটা আঁচড়ে দেয়নি, বা স্পাইক বানিয়েছে ফ্যাশন করে। চলতে চলতে ‘কমন মর্মন’, ‘ব্লু-টাইগার’, ‘মনার্ক’ প্রজাপতিদের হাওয়ায় শরীর ভাসিয়ে দেওয়া ডানার গান শুনে মন হারাই। রোদ বাড়ছে। ফিরলাম রেস্ট হাউসে।
দুপুরের খাওয়া-শেষে বারান্দায় চেয়ার টেনে বসলাম যখন, তখন জঙ্গলের অদূরেই নাগকেশর গাছটার গা জড়িয়ে কাঠবিড়ালিদের খুনসুটি। দারুণ মিষ্টি সুরে একটা দোয়েল শিস দিচ্ছে। মন ফেরে সুনীলের ডাকে। ‘স্যর রোদ পড়েছে, বেরোবেন না?’ ক্যামেরার ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে আসি। দেখা মিলল ‘কেপড্ লেঙ্গুরের’। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় চোখগুলো টকটকে পিঙ্গল। তাদের ছাড়িয়ে যাই। সূর্যের আলো প্রায় শেষ। ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল। আমিও রেস্টহাউসের পথে।

ক্লাউডেড লেপার্ড

বাইসন
বারান্দায় সুনীল চা দিয়ে গিয়েছে। বাইরে সোলার আলোগুলো ঘিরে রাতপোকাদের ভিড়। একটা ‘নাইটজার’ ডাকতে শুরু করেছে। ডিনার-শেষে রাতের জঙ্গল দেখতে বেরোলাম যখন, তখন ঘড়ি বলছে রাত প্রায় সাড়ে বারোটা। ক্যামেরা আর হেডল্যাম্প ছাড়া সঙ্গী সুনীল। অনেকটা সময় ঘোরার পরে হঠাৎ দেখি দূরে একটা গাছের মাথায় যেন দুটো টুনি বাল্ব জ্বলছে। সাবধানে পা ফেলছি শুকনো পাতা এড়িয়ে। আমার হেডল্যাম্প ‘অন’ করলাম, সঙ্গে সুনীলের বড় টর্চ। একটু যেন ঘাবড়ে গাছের উপরে শিকারের সন্ধানে বসে থাকা ক্লাউডেড লেপার্ডটা তাকাল আমাদের দিকে। মিনিট পাঁচেক, তার পরেই দুরন্ত একটা লাফে হারিয়ে গেল জঙ্গলের অন্ধকারে। আমরাও ফিরতে থাকি। পরের দিন জলখাবার সেরে সিপাহিজলার চিড়িয়াখানাটা একপ্রস্ত ঘুরে এলাম। কলকাতার চিড়িয়াখানার হতশ্রী দশা মনে পড়ায় বেশ একটা কষ্ট পাচ্ছিলাম।
প্রায় ৭৫ কিলোমিটার পথ উজিয়ে গাড়ি থামল ‘তৃষ্ণা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি’র দরজায়। স্বাগত জানালেন ডিএফও অনিমেষ দাস। রেস্টহাউসে পৌঁছে স্নান সেরে দুপুরে খেতে বসি। কাঁচা আম দিয়ে পাকা পোনার অসাধারণ একটা পদ রান্না হয়েছিল। দুরন্ত...।
দুপুরে রওনা দিলাম মৈত্রী ইকো পার্ক (ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পার্ক)। এই পার্কের কাজ এখনও শেষ হয়নি। পার্কের ভিতরে কাজুবাদামের বন, শুকিয়ে যাওয়া জলায় কাদায় বাইসনের পায়ের ছাপ। পার্ক দেখা শেষ করে চললাম ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে। বিস্তীর্ণ কাঁটাতারের এ পাশে ভারতের মাটি ধরে চলতে থাকা আমার গাড়িতে বসে থাকতে থাকতেই বাংলাদেশ-সীমান্তে সূর্যকে পাটে বসতে দেখলাম।
অন্ধকার নেমে এসেছে। ফিরে চলি রেস্টহাউসে। রাতের খাওয়া শেষে ফের জঙ্গলে। দেবনাথের সতর্কবাণী মনে পড়ে, ‘দুটো বড় কিং কোবরা আছে।’ জঙ্গলের পথ ধরে এগোই। সামনের অন্ধকার আরও গাঢ়। হঠাৎ দেবনাথের ফিসফিসানি শুনে ইন্দ্রিয় সজাগ হয়। দাঁড়িয়ে যাই। অন্ধকারে প্রায় দু’ডজন আলোর বিন্দু এক জায়গায় স্থির। আমার আর দেবনাথের জোড়া টর্চের আলোয় অন্ধকার পরিষ্কার হয়ে যেতে দেখি গোটা বারো বাইসন তাদের কালো শরীরগুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি আমাদের দিকেই। টর্চ নিভিয়ে দিতেই ধীরে ধীরে আলোর বিন্দুগুলো মিলিয়ে যেতে থাকল জঙ্গলের অন্ধকারে। জঙ্গলের পথ ধরে বেশ কিছুটা ভিতরে এগোই।

বুনো শুয়োর

র‌্যাকেট টেইলড ড্রংগো
আমার মাথার ওপর গাছটায় একটা হালকা শব্দ, কিং-কোবরা? শব্দটা অনুসরণ করে দ্রুত হেডল্যাম্পের সুইচটায় চাপ দিলাম। আহ্! একটা ‘স্লো লরিস’ (লজ্জাবতী বাঁদর)। গোল গোল চোখে ভালমানুষের মতো চকচকে ভেজা নাক বাড়িয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। হাতঘড়ি বলছে রাত দেড়টা। দেবনাথকে নিয়ে ফিরছি যখন পূর্ণিমার চাঁদ তখন জঙ্গলের বুকে।
ঘুম ভাঙল মৌটুসিদের ডাকে। একটা ‘ব্রেইন ফিভার’ ডাকছে থেকে থেকে। সামনের হরিতকি গাছটায় মাথায় একটা ‘বেনে বৌ’ এসে বসল। এ জঙ্গলে প্রচুর গাছ গর্জন, কনক, বহেরা, হরিতকি, জাম, বট, পাকুড়, হারগুজা, কুমিরা, শাল। একটা গর্জনের ডালে একটা মাছরাঙা কমলারঙা ঠোঁট ডোবাচ্ছে তার ফিরোজা নীল পালকে, আর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে এ দিক ও দিক।
রওনা হই বগাপা ফরেস্ট রেঞ্জের দিকে। পথিমধ্যেই ফোন এল ডি এফ ও গৌতম দাসের। হাজির হই তাঁর অফিসে। তিনি পাঠালেন এক গ্রামের মাঝে শান্ত পরিবেশে মহামুনি নামে একটি বৌদ্ধ আশ্রমে। আশ্রমের পরিবেশ মনকাড়া। পরের গন্তব্য ‘পিলাক’। এখানকার ‘ঠাকুরানি টিলা’ (পশ্চিম পিলাক) ও ‘শ্যামসুন্দর টিলা’ (জোলাবাড়ি) দক্ষিণ ত্রিপুরার দুই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। এখানে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গিয়েছে প্রায় ত্রয়োদশ শতাব্দীর বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। পথে পড়ল কালাপানি ইকো পার্ক। পার্কের রেস্তোরাঁর সামনে জিপের হর্নের আওয়াজে ফিরে তাকাই। বগাপা রেঞ্জের রেঞ্জার হাজির আমাকে নিয়ে যেতে।
এ জঙ্গলে বিখ্যাত ‘হুলক গিবন’। এ যাত্রায় তার দেখা না মিললেও ‘কল’ শুনেছি। তবে লেন্সবন্দি হয়েছে ‘ইন্ডিয়ান পাইথন’ (অজগর), লালমুখো বাঁদর (ম্যাকাকা মুলাটা), নানা ধরনের মাকড়সা। দুপুরে ‘বসুন্ধরা’ ফরেস্ট গেস্ট হাউসে চেখে দেখলাম এখানকার বিখ্যাত পদ ‘পোদক’, শুকনো মাছ দিয়ে নানা রকমের সব্জিসিদ্ধ, সঙ্গে ‘পর্ক’। বিকেল চারটেয় ফিরে আসি তৃষ্ণায়।
চারটে পঁয়তাল্লিশ। সূর্যের তেজ কমেছে। আমি, সারথি বিপ্লব, আর মাখনবাবু (বনবিভাগের কর্মী) বসে আছি দূরে জঙ্গলটার দিকে তাকিয়ে। প্রায় আধঘণ্টা পরে মাখনবাবু বললেন ‘চলুন, এগোনো যাক।’ প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ছোট ছোট ঝোপের আড়ালে চলেছি আমরা, একটা ছোট টিলার ঢাল ছাড়িয়ে মুখ বাড়াতেই দেখি, প্রায় চল্লিশ ফুট দূরে ছ’টা বাইসনের একটা দল। তাদের চকচকে কালো শরীরে দিনশেষের আলো। একটু এগোতেই মাখনবাবুর সাবধানবাণী ‘আর এগোবেন না! চার্জ করবে!’ ওঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি আরও চার পা এগিয়ে গেছি। হঠাৎ ওই দলটার মধ্যে সবথেকে বড় বাইসনটা মুখটা উঁচু করল, হাওয়ায় গন্ধ শুঁকল, তার পরে ঘুরে দাঁড়াল আমার মুখোমুখি। প্রায় দশ মিনিট একই ভাবে দাঁড়িয়ে। দলটাকে নিরাপত্তা দিচ্ছে। ধীরে ধীরে পিছু হটলাম।
আজ পূর্ণিমা। আকাশ ভরে চাঁদ উঠেছে। বনজ্যোৎস্নায় জলার জলে তার ছবিতে হাওয়া দোলা দিয়ে যাচ্ছে...ছোট ছোট জলগুল্মের ফাঁকে সে ছবি ভাঙছে...। জঙ্গলের গভীরে একটা ‘বার্কিং ডিয়ার’ ডাকছে, সাথীকে খুঁজছে বোধহয়। কত কী যে বলার আছে জঙ্গলের। এই মৌনতার থই পায় না মন। আজ আর ঘুম নেই। জ্যোৎস্না মিলিয়ে যায়, ভোর হয় এক সময়। মৌটুসিটা আজও এসেছে।
ফিরছি এ বার আগরতলার দিকে। প্রায় ৯৫ কিমি রাস্তা। সকাল সাড়ে ন’টায় পৌঁছে গেলাম। বিপ্লবকে বিদায় জানাই। হঠাৎই আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে ছেলেটা। ‘ফোন নম্বর তো রইল স্যার, আবার এলে ফোন করবেন কিন্তু। আপনার সঙ্গে হুলক গিবন দেখতে যাব।’ আরে, এ ছেলেও তো দেখি জঙ্গলে মজেছে।

চশমা-বাঁদর
কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে আগরতলা বিমানে প্রায় ৫০ মিনিট। কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা
বাস সার্ভিসও আছে। রেলপথেও আগরতলা যাওয়া যায়। কলকাতা থেকে
গুয়াহাটি-লামডিং-আগরতলা। সময় লাগে আড়াই দিন। আগরতলার নাগেরজলা
বাসস্ট্যান্ড থেকে দ্রষ্টব্য স্থানগুলোয় যাওয়ার বাস বা গাড়ি মেলে।
কোথায় থাকবেন
আগরতলা শহরে বিভিন্ন মানের হোটেল আছে, বেসরকারি ব্যবস্থায়। সরকারি
ব্যবস্থাপনাতেও কিছু জায়গায় থাকা যায়। সিপাহিজলা বা তৃষ্ণায় থাকার
জন্য ত্রিপুরা বন দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
কখন যাবেন
সবচেয়ে ভাল সময় সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ।

ছবি: লেখক।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.