মহাকাল তাঁহাকে কী ভাবে স্মরণ করিবে, এই প্রশ্নের পিঠে জ্যোতি বসু পাল্টা প্রশ্ন করিয়াছিলেন মহাকাল কি আদৌ কাহাকেও স্মরণে রাখে? মহাকালের পরীক্ষাটি এখনও বাকি, কিন্তু সমকাল, তাঁহার সক্রিয় রাজনীতির পরিসর হইতে নিষ্ক্রমণের দেড় দশক পরে, জ্যোতিকিরণ বসুকে কী ভাবে স্মরণ করিতেছে? এই মুহূর্তে যাঁহারা পশ্চিমবঙ্গে ভোটাধিকারী, তাঁহাদের একটি বড় অংশের জীবনের অন্তত কিছু বৎসর জ্যোতি বসুর মুখ্যমন্ত্রিত্বে কাটিয়াছে। তাঁহারা কমপক্ষে তিন জন মুখ্যমন্ত্রীর শাসনের সাক্ষী। ফলে, তাঁহাদের মনে একটি তুলনামূলক আলোচনা অনিবার্য হইয়া উঠিবে। সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গের সহিত তুলনা করিলে জ্যোতিবাবুর ভদ্রতাবোধ, পরিমিতিজ্ঞান বা নিজের সীমা সম্পর্কে সচেতনতা অলীক বোধ হইতে পারে। কেহ হয়তো বানতলা-পরবর্তী মন্তব্যের কথা স্মরণ করাইয়া দিবেন, হয়তো স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাইয়ের প্রসঙ্গ উত্থাপন করিবেন, কিন্তু জ্যোতিবাবুর দীর্ঘ সাড়ে তেইশ বৎসরব্যাপী মুখ্যমন্ত্রিত্বে এই ঘটনাগুলি ব্যতিক্রম। তাঁহার সাফল্যের তালিকাটি হ্রস্ব নহে। প্রথম এবং প্রধানতম সাফল্য অবশ্যই বামফ্রন্ট নামক সাড়ে বত্রিশ ভাজাটিকে ধরিয়া রাখিতে পারা। ভারতের জোট রাজনীতিতে তিনি নিঃসন্দেহে অগ্রপথিক। ১৯৭৭ সালেই কেন্দ্রে জনতা জোট সরকার ক্ষমতায় আসিয়াছিল। তাহার ইতিহাস স্মরণ করিলে জ্যোতি বসুর কৃতিত্ব বোঝা সম্ভব। তিনি পশ্চিমবঙ্গে আইনের শাসন ফিরাইয়াছিলেন, এই কথাটিও ভুল নহে। অপারেশন বর্গা এবং পঞ্চায়েতি রাজ, তাঁহাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি হইতে, তাঁহার সরকারের আর একটি কৃতিত্ব।
তবুও সমকাল অথবা মহাকাল, কোনও পরীক্ষকই জ্যোতি বসুর প্রতি উদার হইতে পারিবে না। তিনি স্বয়ং সেই রাস্তা মারিয়া রাখিয়াছেন। তাঁহার আমলেই পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক স্তর হইতে ইংরাজি উঠিয়া যায়; ১৯৮৩ সালে বেসরকারি ব্যাঙ্কে কম্পিউটার বসাইবার উদ্যোগটি বানচাল করিয়া পশ্চিমবঙ্গকে তথ্যপ্রযুক্তির পথে কয়েক ধাপ পিছাইয়া দেওয়ার ব্যবস্থা পাকা হয়; পশ্চিমবঙ্গ শিল্প-শ্মশানে পরিণত হয়। জ্যোতি বসু অবিচলিত নিস্পৃহতায় পশ্চিমবঙ্গের এই অগস্ত্যযাত্রা দেখিয়াছিলেন। বিস্ময়কর, কারণ তিনি স্বয়ং আলোকপ্রাপ্ত ছিলেন। কলিকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজই হউক অথবা লন্ডনে মিডল টেম্পলই হউক, তিনি শিক্ষার, বিশেষত ইংরাজি শিক্ষার, মাহাত্ম্য বিষয়ে সচেতন ছিলেন, এমন অনুমান অসংগত হইবে না। রাজ্য শিল্পহীন হইলে ভবিষ্যৎ কোন সংকটের সম্মুখীন হইবে, তাহা বুঝিতে পারাও তাঁহার ক্ষমতার অতীত ছিল বলিয়া বোধ হয় না। তবু তিনি আপন নিশ্চেষ্টতায় অচল ছিলেন, দলের নির্দেশের বিপরীত স্রোতে সাঁতার কাটিবার সাহস দেখান নাই এক বারও। কেহ বলিবেন, দলের প্রতি অবিচলিত আনুগত্যই কমিউনিস্ট নেতার অগ্নিপরীক্ষা। হয়তো। কিন্তু সেই আনুগত্য বজায় রাখিতে তিনি রাজ্যের স্বার্থ দলাঞ্জলি দিয়াছিলেন। ইতিহাস সে কথা ভুলিবে না।
জ্যোতি বসু স্থিতাবস্থার সাধক ছিলেন। তাঁহাকে একশো ভাগ বাঙালি বলিয়া দাবি করা মুশকিল লোকে তাঁহাকে ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত সাহেব রূপেই চিনিত। কিন্তু বাঙালি কী চাহে, জ্যোতি বসু বিলক্ষণ বুঝিয়াছিলেন। বাঙালি ছোট পুকুরের বাসিন্দা ঢেউ তাহার মনোমত নহে। স্থিতপ্রজ্ঞ জ্যোতি বসুর মুখ্যমন্ত্রিত্ব ঢেউহীন। দল তাঁহাকে যে পথে টানিয়াছে, তিনি বিনা বাধায় ভাসিয়া গিয়াছেন। শিল্পের জন্য, শিক্ষার জন্য, স্বাস্থ্যের জন্য, আধুনিকীকরণের জন্য কোথাও তিনি ঘুরিয়া দাঁড়াইতে চাহেন নাই। জীবনে এক বার মাত্র ‘বিদ্রোহ’ করিয়াছিলেন তাঁহাকে প্রধানমন্ত্রী না হইতে দেওয়ার দলীয় সিদ্ধান্তকে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ বলিয়া। তাহা ব্যতীত জ্যোতিবাবু বিরোধহীন, প্রতিরোধহীন অতএব সফল। তাঁহার উত্তরসূরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এই ভবিষ্যৎহীন স্থিতাবস্থা ভাঙিতে চাহিয়াছিলেন। বাঙালি পছন্দ করে নাই। তাঁহার উত্তরসূরি ফের স্থিতাবস্থায় ফিরিয়াছেন। এই বঙ্গজ জাড্য আদৌ ভাঙা যায় কি না, সাড়ে তেইশ বৎসরে এক বারও সেই কথা না ভাবাই জ্যোতি বসুর বৃহত্তম খামতি। তাঁহার সেই ট্র্যাডিশন আজও চলিতেছে। |