চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...
সঙ্গীতের সন্ধানেই ব্যাপৃত শিল্পীর অস্তিত্ব ও বিলয়
ভাস্কর গোপীনাথ রায় অ্যাকাডেমিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত তাঁর ভাস্কর্যের একক প্রদর্শনীর স্মারকপত্রের ভূমিকায় বলেছেন, ‘আমার অস্তিত্ব, আমার বিলয় সঙ্গীতের সন্ধানে ব্যাপৃত থাকে’। কিন্তু সেই সঙ্গীত মেহগনিতে তৈরি পিয়ানো নিঃসৃত কোনও সুর নয়, তিনি সুর শুনতে পান পাথরের এবড়ো-খেবড়ো পৃষ্ঠতলে, ভাঙা আয়নার ক্ষণস্থায়ী প্রতিফলনের মধ্যে। ভাস্কর্যকে এ রকম সাঙ্গীতিক প্রেক্ষাপটে বিমূর্ততার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার নজির আমাদের আধুনিক ভাস্কর্যে খুব বেশি নেই। সে দিক থেকে গোপীনাথ তাঁর ভাস্কর্যে নতুন আঙ্গিক ও ভাবনা নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন দীর্ঘ দিন থেকে। এবং এই ক্ষেত্রে স্বকীয় এক প্রকাশভঙ্গিও তিনি তৈরি করেছেন যা আধুনিক ভাস্কর্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
এই যে সুর তিনি অনুভব করেন ও নিরীক্ষণ করেন যে কোনও বস্তুর মধ্যে সেটা তাঁর আন্তর অনুভূতির বিষাদমগ্নতারই প্রতিফলন। সেই বিষাদকে তিনি মগ্ন আনন্দে রূপান্তরিত করেন তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে। এই রূপান্তরণ প্রক্রিয়ায় তিনি খুব সন্তর্পণে প্রকৃতিকে ছুঁয়ে যান। আলোচ্য প্রদর্শনীর শিরোনাম: ‘নেচার মেলোডি স্কাল্পচার’। এই নামের মধ্যে দিয়ে তাঁর ভাবনার অভিমুখটি বোঝা যায়। পাথর, কাঠ, সিরামিকস, কাচ ইত্যাদি নানা মাধ্যমে তিনি কাজ করেছেন। একাধিক মাধ্যমকে মিলিয়ে দিয়েছেন।
শিল্পী: গোপীনাথ রায়
আমাদের আধুনিক ভাস্কর্যে প্রকৃতির পরিচিত অবয়বের প্রাধান্য ছিল অনেক দিন। প্রাচীন ধ্রুপদী ভাস্কর্যেও অবশ্য অবয়বের প্রাধান্য ছিল। পাশাপাশি প্রতিমাকল্পকে প্রতীকে রূপান্তরণের দৃষ্টান্তও বিরল নয়। প্রথম পর্বের বৌদ্ধধর্ম অনুপ্রাণিত ভাস্কর্য এর দৃষ্টান্ত। শিবলিঙ্গ বা শালগ্রাম শিলাও তো ভাস্কর্যেরই এক একটি রূপ যেখানে প্রতিমা প্রতীকে রূপান্তরিত হয়েছে। আমাদের আধুনিকতাবাদী ভাস্কর্যের সূচনা রামকিঙ্কর থেকে। ১৯৪০ থেকে ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত ভাস্করদের রচনায় মূর্ততা প্রাধান্য পেয়েছে। মীরা মুখোপাধ্যায়ই প্রথম লৌকিকের প্রেরণায় ভাস্কর্যে দ্বিমাত্রিক পরিসরকে ব্যাপ্ত করে নিসর্গের বিস্তারকে ধরেছেন। গোপীনাথের কাজে এই আঙ্গিকের কিছু পরোক্ষ প্রতিফলন দেখা যায়। যদিও লৌকিকের সারল্য নয়, ব্যক্তিগত নাগরিক মননে তাঁর কাজ অনেক পরিশীলিত। ত্রিমাত্রিক পূর্ণাবয়ব মূর্তির প্রাধান্য ভাঙতে থেকেছে সত্তরের দশকের অনেক শিল্পীর কাজে। শান্তিনিকেতনের সুষেণ ঘোষের মতো গাণিতিক বিমূর্ততায় না গেলেও, লতিকা কাঠ বা জনকঝংকার নার্জারির কাজে দার্শনিক প্রত্যয়ের ভিতর দিয়ে ত্রিমাত্রিকতার ভিতরে দ্বিমাত্রিক বিস্তার অনেকটা প্রাধান্য পেয়েছে।
গোপীনাথ রায় ১৯৮০-র দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পী। ভাস্কর্যের ভিতর দিয়ে তিনি যে ভাবে ব্যক্তিগত নির্জনতার বোধকে প্রতিফলিত করেন, তাঁর প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে এর অন্য দৃষ্টান্ত খুব বেশি নেই।
একটি পাথরকে কেটে কেটে পৃষ্ঠতলে অমসৃণ বুনোটের মধ্য দিয়ে এক বিষাদের আবরণ তৈরি করেছেন। তার পর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ঈষৎ গভীর করে কেটে বের করে এনেছেন সবুজ এক স্রোতধারা। এই স্রোতধারা সুরে অনুরণিত হতে থাকে। তীরে একটি অবয়ব থাকে, যাতে অনুভব করা যায় পাখির আদল। নির্জনতায় স্পন্দিত সুর তাঁর ভাস্কর্যের বিশেষ একটি মাত্রা। মৃত্তিকার পাতলা চাদরকে গুটিয়ে সিরামিকসের বিশেষ এক আলুলায়িত আকৃতি তৈরি করেছেন। গোটানো পরিসরের ভিতর যে শূন্যতা সৃজিত হয়েছে, তার নীরব সংলাপ চলে পরিবৃত বস্তুপুঞ্জের সঙ্গে। এক প্রান্তে কয়েকটি ধাতব শলাকা আটকে দেন। তাতে জলযানের গতিপ্রবাহ সঞ্চারিত হয়। একটি পুরু কাচের প্লেটকে দাঁড় করিয়ে দেন। তার একটি প্রান্ত আলুলায়িত ভাবে কেটে নিয়ে সেখানে অমসৃণ বুনোট তৈরি করেন।
তাতেই অনুচ্চার এক সুরের আভাস আসে। উত্তুঙ্গ স্তূপসম এক পরিসর। ভূমিতলে বৃত্তাকার প্রস্থচ্ছেদ। ক্রমান্বয়ে উপরের দিকে উঠে বিন্দুতে মিলিয়েছে। লালচে বাদামি বর্ণ। শরীর জুড়ে কোটরের মতো বুনোট। বৃত্তাকারে ক্রমান্বয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে। শীর্ষবিন্দু থেকে বক্র পৃষ্ঠতলের কিছু অংশ জুড়ে আলুলায়িত ছড়িয়ে গেছে সাদার উপর নীলাভ এক স্রোত। শব্দে গাঁথা বর্ণনার এ রকম ব্যর্থ প্রয়াস থেকে তাঁর ভাস্কর্যের স্বরূপ বোঝা দুরূহ। প্রত্যেকটিকে আলাদা করে চিহ্নিত করার মতো কোনও শিরোনামও নেই। প্রকৃতিকে বিমূর্তায়িত করে সুরে অনুরণিত করা, এই তাঁর ভাস্কর্যের প্রধান অভিমুখ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.