দৃশ্য ১: নিউ টাউন-নারকেলবাগান মোড়। সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা। নিউ টাউন মোড় থেকে বিমানবন্দরমুখী বাস আসতে দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়ল নারকেলবাগান মোড়ে দাঁড়ানো জটলাটা। আধো অন্ধকার ওই মোড়ে বাস দাঁড়ানোর নির্দিষ্ট কোনও জায়গাও নেই। বাস থামতেই শুরু ‘শক্তি প্রদর্শনের’ লড়াই। যার গায়ে জোর বেশি, তারই বাসে ওঠার অধিকার। মরিয়া যাত্রীরা অনেকেই গেটের রড ধরে ঝুলে পড়লেন। রীতিমতো প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই রওনা দিলেন গন্তব্যের দিকে। যাঁরা পেরে উঠলেন না, তাঁরা পড়ে রইলেন আলো-আঁধারি বাস স্টপে। এমনই এক যাত্রীর আক্ষেপ, “রোজই এক অবস্থা। বাস কম। এ বার বৃষ্টি নামলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজতে হবে।” এই সুযোগে নারকেলবাগান মোড়ে তখন ‘এয়ারপোর্ট ২০ টাকা’ দর হাঁকছে শাট্ল গাড়ি। রাত বাড়লে আরও বাড়বে ভাড়া।
দৃশ্য ২: নিউ টাউন বাসস্ট্যান্ড। স্ট্যান্ডে গুটিকয়েক বাস দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাসের আশায় আসা অধিকাংশই বিরস মুখে ফিরে যাচ্ছেন। হাতেগোনা যে ক’টা বাস দাঁড়িয়ে, তার বেশির ভাগই গ্যারাজ হয়ে গিয়েছে বলে জানালেন কনডাক্টররা। যে কয়েকটি যাবে, সেগুলো কখন ছাড়বে বলতে পারছেন না কেউই। অগত্যা রাস্তাতেই দাঁড়াতে হচ্ছে অফিস-ফেরত যাত্রীদের। সেখানে শাটলের রমরমা। এই মোড় থেকে প্রচুর মহিলা নিত্যযাত্রী বাড়ি ফেরেন। তাঁদের এক জনের অভিযোগ, “যে শাটলগুলো সামনে এসে দাঁড়ায়, তাতে অনেক সময়েই সহযাত্রীরা সকলে অচেনা পুরুষ। ফলে অস্বস্তি হয়। তা ছাড়া, নিউ টাউনের অন্ধকার রাস্তায় নিরাপত্তাহীন ভাবে আমাদের মতো মহিলা যাত্রীদের ফিরতে হয়।” |
দৃশ্য ৩: এসডিএফ মোড়। সন্ধ্যা ৬টা। যতগুলি বাসের দেখা মিলল, যাত্রীর ভিড় তার বহুগুণ বেশি। এক ঘণ্টা দাঁড়িয়েও ভলভো বাসের দেখা পাওয়া গেল না। এক নিত্যযাত্রী বরুণ দাস বলেন, “বাস নেই, এমনটা নয়। এক-একটা রুটে বাসের সংখ্যা কমেছে। কিন্তু পাঁচ নম্বর সেক্টরে কর্মীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ফলে অটোর রমরমা। উল্টোডাঙা স্টেশন থেকে ব্রেক জার্নি করে রোজ ৪০ টাকা দিয়ে অফিসে যাতায়াত করা সম্ভব? তাই কোনও মতে ঠেসেঠুসে বেসরকারি বাসে উঠে পড়ছি।”
দৃশ্য ৪: টেকনোপলিস মোড়। সন্ধ্যা ৭টা ৪৫। সংবাদমাধ্যমের গাড়ি দাঁড়াতেই অন্তত ৪০ জন হাজির। কেউ জিজ্ঞাসা করলেন পার্ক সার্কাস যাবে কি না, কেউ বা গড়িয়াহাট। কেন? বাস নেই? পাল্টা জবাব এল, ‘‘নতুন নাকি? কবে বাস থাকে?’’
দৃশ্য ৫: পাঁচ নম্বর সেক্টরের কলেজ মোড়। সন্ধ্যা ৭টা। প্রায় ৪০ মিনিট ধরে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন গড়িয়ার সুস্মিতা বসু। বাসের কথা জিজ্ঞাসা করতেই একরাশ হতাশা তাঁর গলায়। “শুনেছিলাম পাঁচ মিনিট অন্তর ভলভো বাস পাব। কোথায় কী! ৪০ মিনিটে একটা বাস এল, তা-ও বাদুড়ঝোলা। অগত্যা বেশি ভাড়া দিয়ে অটোতেই যাব।”
অথচ কিছু দিন আগে ছবিটা বদলে যাওয়ার এক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। পাঁচ মিনিট অন্তর রাস্তায় বাস দেখতে পেয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন তথ্যপ্রযুক্তির কর্মীরা।
এক দিকে অটোর দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ, অন্য দিকে তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় রেখে মাসখানেক আগে ঘটা করে চালু হয়েছিল ভলভো-সহ বাস পরিষেবা। এ ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে উল্টোডাঙা, শিয়ালদহ, হাওড়া, গড়িয়া-টালিগঞ্জ, বারাসতমুখী একাধিক বাসের রুট চালু রয়েছে এই সেক্টরে। রাজ্য পরিবহণ দফতর আশ্বাস দিয়েছিল, এ বার বাসের আর কোনও সমস্যা থাকবে না।
মাত্র এক মাসে বদলে গেল সম্ভাবনার ছবিটাই। যে ছবিতে এখন আশ্বাসের সঙ্গে বাস্তবের ঢের ফারাক। প্রায় ঘণ্টাখানেক নিউ টাউন ও সল্টলেক সেক্টর ফাইভের তথ্যপ্রযুক্তি তালুকে ঘুরে ভলভো বাস দেখা গেল হাতে গোনা। ভলভো বাস ছাড়া অন্য বাসের সংখ্যাও কম। প্রায় সব ক’টারই বাদুড়ঝোলা অবস্থা। নিউ টাউনের এক তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী নিবেদিতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বাবার কাছে গল্প শুনেছি, কলকাতায় মেট্রো রেল চালু হওয়ার আগে বাসগুলোতে এমন বাদুরঝোলা অবস্থা হত। এখন আমাদের এখানে এই অবস্থা!” |
|
|
চিত্র ২: নিউ টাউনের স্ট্যান্ডে
বাসে ওঠার ‘মরিয়া লড়াই’। |
চিত্র ৩: কলেজ মোড়ের (সেক্টর ৫)
কাছে শাটল ধরার হুড়োহুড়ি। |
|
নিত্যযাত্রীদের ক্ষোভ যে একেবারে অসঙ্গত নয়, তার প্রমাণ পেতে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। মাত্র পনেরো মিনিটেই পরিবহণ পরিষেবার হালটা স্পষ্ট। নিউ টাউন থেকে কলকাতা স্টেশনগামী ভূতল পরিবহণের বাস টেকনোপলিস মোড়ে যেতেই রীতিমতো ধস্তাধস্তির অবস্থা। কিন্তু ওই ছোট বাসগুলোতে অত যাত্রী নেওয়ার জায়গা কোথায়? যারা উঠতে পারলেন না, অগত্যা তাঁরা ফের অপেক্ষার সারিতে। হাল ছেড়ে দিয়ে অনেকে উঠে পড়লেন অটোয়।
কোথায় গেল ঘটা করে উদ্বোধন হওয়া ভলভো বাস? ভূতল পরিবহণের বাসই বা এত কম কেন? যদিও বাস কম থাকার কথা সরাসরি মানতে রাজি হননি হিডকোর চেয়ারম্যান দেবাশিস সেন। তিনি বলেন, “নিউ টাউনে অফিসযাত্রীদের জন্য ভলভো বাসের সংখ্যা বেড়েছে। উদ্বোধন হওয়া বাসগুলোও চলছে। পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে নিউ টাউনে বাসের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে। তবে তথ্যপ্রযুক্তি অফিসের শিফট শেষে অনেক যাত্রী একসঙ্গে জড়ো হয়ে যান বলে বাসের একটু সমস্যা হয়।” অন্য দিকে পরিবহণ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, শুধু বাসের সংখ্যা বাড়ানোই নয়, নিউ টাউনের তথ্যপ্রযুক্তি এলাকার কাছে একটি বড় বাস টার্মিনাস তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে যাত্রীরা সব দিকে যাওয়ারই বাস পাবেন। পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের আশ্বাস, “নিউ টাউনের পরিবহণ ব্যবস্থা যে ভাবে সাজানো হচ্ছে, তাতে আগামী দু’বছরে বাসের সমস্যা থাকবে না।”
পাঁচ নম্বর সেক্টরের প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা নবদিগন্ত শিল্পনগরী কর্তৃপক্ষের কার্যনির্বাহী আধিকারিক বদ্রিনারায়ণ কর বলেন, “পরিবহণের সমস্যা মেটাতে নতুন পরিকল্পনা ইতিমধ্যেই কার্যকরী হয়েছে। সে ক্ষেত্রে তিনটি জায়গা থেকে পাঁচ মিনিট অন্তর বাস থাকার কথা। অভিযোগ শুনলাম। দ্রুত ভূতল পরিবহণের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে।”
|