কেবল আদালতে এলেই জনস্বার্থের কথা মনে হয়। কিন্তু সকলের সামনে যখন একটা বেআইনি কাজ চলে, তখন জনস্বার্থের প্রশ্ন ওঠে না কেন? রাজ্য সরকারের আইনজীবীর কাছে তা জানতে চাইলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়।
এ বছর বাংলা, ইংরেজি-সহ আটটি পাঠ্যবই প্রকাশ ও বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ। বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় মঙ্গলবার সেই প্রক্রিয়ার উপরে যে-স্থগিতাদেশ জারি করেছেন, তা এক বছরের জন্য শিথিল করতে বৃহস্পতিবার আর্জি জানান সরকারি আইনজীবী জিপি অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানান, স্কুলগুলিতে একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। ওই সব বই ছেপে তৈরি। স্থগিতাদেশ শিথিল করলে এক বছরের জন্য বইগুলি ছাড় পাবে এবং কয়েক দিনের মধ্যেই সেগুলো ছাত্রছাত্রীদের হাতে পৌঁছে যাবে। কিন্তু এই অবস্থায় বই প্রকাশ বন্ধ থাকলে ছাত্রছাত্রীরা সমস্যায় পড়বেন। জিপি আদালতে বলেন, “জনস্বার্থেই আমি এই আবেদন জানাচ্ছি।”
বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেই আবেদন খারিজ করে দেন। তখনই তিনি বলেন, “শুধু আদালতে এলেই আপনাদের জনস্বার্থের কথা মনে হয়! যখন এত বড় কেলেঙ্কারি ঘটছিল, তখন সরকার কোথায় ছিল? তখন জনস্বার্থের কথা সরকারের মাথায় আসেনি কেন?”
উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের আইনজীবী এক্রামুল বারি আদালতের কাছে একটি প্রস্তাব দেন। বলেন, “এই মামলার অভিযোগকারী (সর্বোচ্চ দর দিয়েও যে-প্রকাশনা সংস্থা বই ছাপার বরাত পায়নি)-র সঙ্গে সংসদ-কর্তৃপক্ষ একান্ত ভাবে কথা বলতে চান।”
বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রস্তাবে রাজি হন। তিনি বলেন, “অভিযোগকারী প্রকাশনা সংস্থা এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের মধ্যে আলোচনার ফল কী হল, ২৪ ঘণ্টা পরে অর্থাৎ শুক্রবারেই দু’পক্ষকে আদালতে এসে তা জানাতে হবে।” উভয় তরফের বক্তব্য শুনে বিচারপতি আজ, শুক্রবারেই জানিয়ে দেবেন, একাদশ শ্রেণির বই প্রকাশ ও বিক্রির উপরে স্থগিতাদেশ জারি থাকবে কি না। স্থগিতাদেশ না-উঠলে একাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের হাতে বাংলা ও ইংরেজি বই পৌঁছবে না বলে সংসদ সূত্রে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
এক্রামুল এ দিন আদালতের বাইরে জানান, দু’পক্ষের (সংসদ এবং অভিযোগকারী প্রকাশনা সংস্থা) আইনজীবীদের আলোচনায় উপস্থিত থাকার জন্য অ্যাডভোকেট জেনারেলের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত আদালতকে জানানো হবে। প্রয়োজনে ওই বৈঠকে সংসদ-সভাপতি মুক্তিনাথ চট্টোপাধ্যায়কেও থাকতে বলা হবে বলে জানান এক্রামুল। মুক্তিনাথবাবু অবশ্য এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই বৈঠকও হয়নি।
বই প্রকাশের বিষয়টি আদালতের গোচরে এল কী ভাবে?
এ বার যে-আটটি বই উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের প্রকাশ করার কথা ছিল, সেগুলি ছাপার বরাত দিতে বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার কাছে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। সেই প্রক্রিয়ায় যে-প্রকাশনা সংস্থা সর্বোচ্চ দর দিয়েছিল, তাদের বরাত না-দেওয়ায় মে মাসে সংসদের অন্দরেই বিতর্ক বেধেছিল। যে-পদ্ধতিতে বরাত দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে ওই মাসে রাজ্যের স্কুলশিক্ষা দফতরে চিঠি পাঠান সংসদের সচিব অচিন্ত্য পাল। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পর্যবেক্ষক দল গড়ে দেয় স্কুলশিক্ষা দফতর। কিন্তু তাতেও কাজের কাজ কিছু হয়নি।
স্কুলশিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, বই প্রকাশের সরকারি নীতি অনুযায়ী সংসদের আর্থিক ক্ষতি করে কোনও সংস্থাকে বই প্রকাশের বরাত দেওয়ার কথা নয়। তা সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দরদাতা সংস্থাকে বাদ দিয়ে অন্য সংস্থাকে বরাত দেওয়া হয়েছে। এতে সংসদের লোকসান হয়েছে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। এটাই সব নয়। আগে বাংলা ও ইংরেজি বই ছাপত বিশ্বভারতী। আগেকার পাঠ্যক্রম অনুযায়ী ছাপা, অবিক্রীত বই বাবদ সংসদের কাছে আড়াই কোটি টাকা দাবি করেছে তারা।
সংসদের আধিকারিকদের একাংশ মনে করছেন, বই ছাপার বরাত যে বিশেষ একটি সংস্থাকেই দেওয়া হবে, দরপত্র চাওয়ার আগেই তা ঠিক হয়ে গিয়েছিল। সেটা বোঝা গেল কী ভাবে? ওই সব আধিকারিকের বক্তব্য, দরপত্র ডাকা হয় এপ্রিলে। আর বাজারে যে-বই বিক্রি হচ্ছে, সংসদ-সভাপতি তার মুখবন্ধ লিখে ফেলেছিলেন মার্চে। এর থেকেই ওই বিশেষ প্রকাশনা সংস্থার প্রতি সংসদ-কর্তৃপক্ষের পক্ষপাতিত্ব স্পষ্ট হয়। ওই সব আধিকারিকদের একাংশের মতে, দুর্নীতির যে-বিষয়টি এত দিন সংসদ এবং স্কুলশিক্ষা দফতরে ফাইল-চাপা হয়ে পড়ে ছিল, সর্বোচ্চ দর দেওয়া প্রকাশনা সংস্থাটি হাইকোর্টে মামলা করে সেটা প্রকাশ্যে এনে দিল।
|