কেশর-পেস্তা আইসক্রিমের বার-টা রোজ ফ্রিজ খুলে দেখেন বিদিতা ভট্টাচার্য। দুধে আলতা রঙের চৌকো বাক্সে থাকা আইসক্রিমের টাটকা স্মৃতিই সান্ত্বনা দেয়, স্বপ্ন দেখায় সব ঠিক হয়ে যাবে। বাড়ি ফিরে আসবেন মামারা।
গঢ়বালে বেড়াতে যাওয়ার আগে মামা আইসক্রিমের এই বারটা উপহার দিয়ে বলেছিলেন, “ঠান্ডার দেশে চললাম তো, তোরাও এনজয় করিস টুয়া।” টুয়া অর্থাৎ বিদিতা আর তাঁর স্বামী পুষ্পল যে আসলে আইসক্রিমের পোকা, মামা-মামীর তা বিলক্ষণ জানা ছিল।
মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে ইমেজ ফোল্ডারে থাকা ছবিগুলো পর পর দেখছিলেন বিদিশা। ছবি দেখাটা অছিলা। আচমকা যদি বেজে ওঠে, সেই অপেক্ষাতেই ফোনটা নিজের মুঠোয় রাখা। ঠিক যেমন সপ্তাহ তিনেক আগে ফোন এসেছিল “টুয়া, চললাম রে। কেদারনাথ যাচ্ছি। গিয়ে ফোন করব। ভাল থাকিস সব।”
ও প্রান্তে থাকা মানুষটা আবার ফোন করবেন দৃঢ় বিশ্বাস টুয়ার। ‘কী ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে ফিরে এলাম রে টুয়া। কোনও রকমে প্রাণে বেঁচেছি,’ অন্তত এই কথাটা এক বার ভীষণ শুনতে ইচ্ছে করছে বিদিতার। কেঁদে ফেলেন তিনি, “মামারা এই রকমই হুটহাট বেরিয়ে পড়ে। আমি ছাড়া আর কারও কথা শোনে না। ভাগ্নী হলেও ওদের কাছে আমি মেয়ের থেকেও বেশি। যাওয়ার আগে আইসক্রিমটা দিয়ে গিয়েছিলেন মামা। আজও খাওয়া হয়নি।’’ |
উত্তরাখণ্ডে জলি গ্র্যান্ট এয়ারপোর্ট, সহস্ত্রধারা হেলিপ্যাড, হৃষীকেশ বাস স্ট্যান্ড নিখোঁজের সন্ধানে থাকা হাজার কয়েক ছবির মধ্যে খড়দহের রহড়া মধ্যপাড়ার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়, স্ত্রী চন্দনাদেবী ও ছেলে বার্ণিকের ছবিও রেখে এসেছেন বিদিতার স্বামী পুষ্পল। বলেন, “ওর একমাত্র মামা। এত কাছাকাছি বাড়ি আমাদের, যেন একই পরিবার। মামাতো ভাই বার্ণিক ওর থেকে অনেক ছোট। টুয়াই ওকে কোলে-পিঠে মানুষ করেছে। কেমন করে যে ওরা তিন জন ভ্যানিস হয়ে গেল!”
খড়দহের পুরনো বাসিন্দা বিশ্বজিৎবাবু একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। ন’মাস আগে পুরুলিয়ায় বদলি হয়েছেন। বেড়ানোটাই ছিল নেশা। ছেলে বার্ণিক হুগলির গুপ্তিপাড়ার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ে। মধ্যপাড়ার দোতলা বাড়িটির এক তলায় এলাকার সব চেয়ে পুরনো কিন্ডারগার্টেন স্কুলটি চালান চন্দনাদেবী। সেই স্কুলে আপাতত তালা।
গত ডিসেম্বরে কনকনে ঠান্ডায় ওড়িশার কুলডিহার জঙ্গলে সপরিবার ক্যাম্প করে এসেছেন বিশ্বজিৎবাবুরা। কিছু দিন আগে সুন্দরবনে গিয়েছিলেন। কেদার যাওয়ার পরিকল্পনাটা রাতারাতি। ১২ জুন রাতে কলকাতা স্টেশন থেকে বিশেষ ট্রেনে স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে হরিদ্বার রওনা হয়েছিলেন বিশ্বজিৎবাবু। মোবাইলে আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে কথোপকথন থেকে যা জানা গিয়েছে ১৫ জুন হরিদ্বারের একটি এটিএম থেকে টাকা তুলে বিশ্বজিৎবাবুরা শোনপ্রয়াগে যান। সেখান থেকে গৌরীকুণ্ডের দিকে যাওয়ার সময়ে শেষ ফোনটা এসেছিল বার্ণিকের এক বান্ধবীর কাছে। সে দিনও বেশ বৃষ্টি। গৌরীকুণ্ড থেকে রামওয়াড়া, জঙ্গলচটি হয়ে কেদারনাথ ১৪ কিলোমিটারের এই পায়ে হাঁটা পথ হিসেব মতো পেরোনো উচিত ১৬ তারিখ। আর ওই রাতেই প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়, ধস নামে। ১৬ জুন রাতে বিশ্বজিৎবাবুরা রামওয়াড়াতেই ছিলেন, অনুমান পুষ্পলবাবুদের।
সেই রামওয়াড়া যে জনপদ বিলকুল মুছে গিয়েছে ১৭ তারিখ সাতসকালের হড়পা বানে।
বিশ্বজিৎবাবুদের খোঁজে দু’দফায় উত্তরাখণ্ড গিয়েছেন তাঁর স্বজনরা। কয়েক হাজার মানুষের ভিড় ঠেলে প্রতিদিন সকালে বিকালে প্রশাসনের টাঙানো মৃতদের তালিকায় খুঁজেছেন তিন জনের নাম। অনুসন্ধান কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থেকেছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ২৭ জুন সেনাবাহিনীর প্যারাট্রুপাররাও যখন জানিয়ে দিলেন, তল্লাশিতে আর কোনও দেহ মিলছে না, দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরে আসা ছাড়া কী-ই বা করার ছিল তাঁদের।
পুষ্পলবাবুর ক্ষোভ, “নিহত বা আহতদের খোঁজে যে সব রাজ্য অনুসন্ধান কেন্দ্র খুলেছে, সব থেকে করুণ অবস্থা পশ্চিমবঙ্গের। কোনও তথ্য নেই সেখানে। মানবিক আচরণটুকুরও ধার ধারেননি বঙ্গভবন থেকে যাওয়া কর্মীরা।’’
ডায়েরি হয়েছে, খোঁজখবরও হয়েছে বিস্তর। কিন্তু তিনটে মানুষ যেন বেমালুম হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছেন। আশা ছাড়েননি বিদিতা। কেশর-পেস্তা আইসক্রিমটা ডিপ ফ্রিজেই রেখে দিয়েছেন। ওঁরা ফিরলে ভাগ করে খাবেন!
|