শুরুটা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাতে পা মিলিয়েছেন অন্য নেতা-মন্ত্রীরাও। এ দিন সেই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন তমলুকের তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী। নির্বাচনী প্রচার সভা থেকে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডেকে এ দিন নিশানা করেছেন তিনি। প্রতিষ্ঠানের মর্যাদার কথা মাথায় রেখে মীরাদেবী অবশ্য এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করবেন না বলেই জানিয়ে দিয়েছেন। তবে পঞ্চায়েত ভোটের প্রচার-মঞ্চ থেকে রাজ্যের নির্বাচন কমিশনারকে যে ভাবে শাসক দল লাগাতার আক্রমণ করছে, সে ব্যাপারে তারা আইনি পরামর্শ নিতে পারে বলে মঙ্গলবার রাজ্য নির্বাচন কমিশন সূত্রে ইঙ্গিত মিলেছে।
মুখ্যমন্ত্রী ও অন্য নেতা-মন্ত্রীদের লাগাতার আক্রমণ প্রসঙ্গে মীরাদেবী এ দিন জানান, রাজ্য নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানের মর্যাদার কথা মাথায় রেখেই তাঁরা কোনও বিতর্ক চাইছেন না। একই কারণে রবিবার জয়নগরের সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তার সিডি সংগ্রহ করে সেটি দেখলেও তা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি মীরাদেবী। এ দিন রাতে কমিশনের অফিস ছেড়ে যাওয়ার আগে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার বলেন, “সিডি আমি দেখেছি। তবে এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করব না। মন্তব্য করাটা দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় হবে।” তিনি এ দিন রাজভবনে গিয়ে পুরো পরিস্থিতি রাজ্যপালকে জানিয়ে এসেছেন।
রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রী বা অন্য মন্ত্রীদের আক্রমণাত্মক মন্তব্যই শুধু নয়, কমিশনের সঙ্গে রাজ্য সরকারের নতুন লড়াই শুরু হয়েছে প্রচারের সময়ে পর্যাপ্ত বাহিনী পাওয়া নিয়েও। নিরাপত্তার অভাবেই রাজ্যে প্রাক্-নির্বাচনী পর্বে এত হিংসাত্মক ঘটনা ঘটছে বলে মনে করে কমিশন। পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে এ দিন পর্যন্ত রাজনৈতিক সংঘর্ষে ন’জনের মৃত্যু হয়েছে। হিংসা বন্ধে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বাহিনীর দাবিতে কমিশন ফের সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারে বলেও মঙ্গলবার কমিশন সূত্রে ইঙ্গিত মিলেছে।
কমিশনের সচিব তাপস রায় বলেন, “এ বারের নির্বাচন তো আদালতের নির্দেশ মেনেই হচ্ছে। ফলে নির্বাচন পরিচালনায় কোনও অসুবিধা হলে কমিশন আইনের পথেই হাঁটবে। সমস্যায় পড়লে আমরা আদালতের সাহায্য চাইব।” বিভিন্ন ক্ষেত্রেই রাজ্য সরকার যে কমিশনের নির্দেশ মানছে না, এ দিন সেই অভিযোগও তুলেছেন তাপসবাবু। তিনি জানান, পঞ্চায়েত ভোট পরিচালনার জন্য কমিশন যা যা চেয়েছে, তার সবটা পাওয়া যায়নি। যেমন পিংলার ওসিকে সরিয়ে দেওয়ার সুপারিশ কার্যকর হয়নি। তিনি বলেন, “এই নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষ বা রাজনৈতিক দলগুলি যতটা চিন্তিত, কমিশন ঠিক ততটাই চিন্তিত।”
এ দিন পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতনে এক সভায় নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী। কমিশন সেই বক্তব্যের সিডি চেয়ে পাঠিয়েছে বলে জানিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সচিব বলেন, “বলতে পারি, মন্তব্যকারীর সংখ্যা আরও এক জন বাড়ল!”
এ দিন দাঁতনে কী বলেছেন শুভেন্দু? তৃণমূল সাংসদ বলেন, “আমরা জেলার অধিকাংশ আসনে জিতে রয়েছি। এখানেও জিতব। এ দিকে সিপিএমের জামা গায়ে দিয়ে কংগ্রেস ও কংগ্রেসের জামা গায়ে দিয়ে সিপিএম এখানে সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। আমি বলি পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে। এদের পাখা গজিয়েছে। এদের কোন অসুখে কোন ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়, আমি জানি। আমি নন্দীগ্রামে করেছি, জঙ্গলমহলে করেছি। আমি শুধু বলব, ওই ১১ তারিখটা দাঁতে দাঁত চেপে পার করে দিন। কারণ, মীরাদেবী আছেন। মীরা পাণ্ডে মহোদয়া, কমরেড মীরা পাণ্ডে তিনি অপেক্ষা করে আছেন। আমরা তাঁকে সেই সুযোগ দেব না। আমরা ভোট বাতিল করার সুযোগ দেব না। পুনর্নির্বাচন করার সুযোগ দেব না। আমরা গণতান্ত্রিক ভাবে ভোট করব।”
পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্রও এ দিন বর্ধমানের মঙ্গলকোটে মীরা পাণ্ডেকে আক্রমণ করেছেন। তিনি এর আগেও মীরাদেবীকে নিশানা করেছেন। এ দিন মদন বলেন, “লোকে বলছে, কমিশন না কি কমিশনে চলছে! সিপিএম-কংগ্রেসকে ভরসা দিচ্ছে আর আমাদের ডোবানোর চেষ্টা করছে। পুলিশের কোলে সিপিএম-কংগ্রেস দুলবে, এটাই চাইছে কমিশন।” নির্বাচন কমিশন যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তৃতার সিডি চেয়েছে, সে প্রসঙ্গে মদন বলেন, “সিডি নিয়ে ওরা করবে কী? আমাদের ফাঁসি দেবে?”
স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা যে ভাবে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে লাগাতার আক্রমণ করছেন, সে প্রসঙ্গে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু এ দিন বলেন, “মীরা পাণ্ডেকে দেখে নেবেন কি দেখে নেবেন না, আমরা বলার কে? সরকারে নেই আমরা। তবে বলব, গণতন্ত্রের জন্য এমন বলা শোভনীয় নয়। উচিতও নয়।”বিধানসভায় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে মীরাকে ইমপিচ করতেন বলে যে মন্তব্য মুখ্যমন্ত্রী করেছেন, সেই প্রসঙ্গে বিমানবাবু বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী মাঝে মাঝেই এমন ভাবে কথা বলেন, যেন দেশে সংবিধান বলে কিছু নেই! গণতন্ত্র বলে কিছু নেই!” সংবিধান এবং আইন অনুসারে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে যে বিধানসভায় ইমপিচ করা যায় না, সে কথাই উল্লেখ করেছেন বিমানবাবু।
হুগলির পুড়শুড়ায় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য এ দিন বলেন, “মীরা পাণ্ডেকে বারবার আক্রমণ করা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে তো বটেই, শুভেন্দু অধিকারী, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, মদন মিত্র সকলেই আক্রমণ করছেন। আমরা মীরা পাণ্ডের পাশে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক লড়াই করে জানিয়ে দেব, মুখ্যমন্ত্রী যা চাইছেন, তা হবে না।” |