গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় • হিন্দমোটর |
বিভীষিকার ভ্রমণ সেরে দেবভূমি গঢ়বাল থেকে ঘরে ফিরেছেন কেউ,
অনেকেই ফেরেননি। তাঁদের নিয়েই ধারাবাহিক প্রতিবেদন। |
পরিবারের সকলে মিলে হইহই করে বেড়াতে যাবেন, ইচ্ছে ছিল বহু দিনের। কিছুতেই হয়ে উঠত না। এ বারে তাই আটঘাট বাঁধা হয়েছিল অনেক আগে থেকে। গন্তব্য চার ধাম গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী কেদার ও বদ্রী। বেরিয়েছিলেন ১৯ জন। আর প্রকৃতির মারে লন্ডভণ্ড গঢ়বাল থেকে ঘরে ফিরেছেন কেবলই দু’জন। ফিরেছেন জিন্দা লাশ হয়ে! চোখের সামনে বানের জলে ১৭ স্বজনকে ভেসে যেতে দেখেছেন। ভেবেছিলেন পরে খুঁজে পাবেন। কিন্তু সে আর হয়নি।
হুগলির হিন্দমোটরের বিনোদ মন্ত্রী এবং স্ত্রী কুসুমও ছিলেন এই ১৯ জনের দলে। বিনোদ ফিরেছেন। কুসুম নিখোঁজ।
|
কুসুম মন্ত্রী |
স্ত্রীকে নিয়ে ৬ জুন হিন্দমোটর ছেড়েছিলেন বিনোদবাবু। প্রথমে যান ওড়িশার সম্বলপুর, কুসুমদেবীর বাপের বাড়ি। সেখান থেকে আরও ১৭ জনকে সঙ্গী করে বেরিয়ে পড়েন গঢ়বালের উদ্দেশে। ৯ জুন হরিদ্বার। তার পর যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী দর্শন সেরে ১৫ জুন সকলে পৌঁছন কেদারনাথে। ওঠেন রাজস্থান ধর্মশালায়। আর ঠিক সে দিন থেকে মেঘভাঙা বৃষ্টি গঢ়বাল জুড়ে। এক সেকেন্ডও বিরাম নেই সে বর্ষণের। তার মধ্যেই ১৬ তারিখ ভোরে কেদারনাথ মন্দিরে পুজো দেন বিনোদবাবুরা। তাঁর কন্যা ঋতু মলের কথায়, “ঠিক ছিল, ১৬ তারিখ বিকেলেই সকলে গৌরীকুণ্ডে নেমে বাস ধরবেন। কিন্তু আবহাওয়া খারাপ থাকায় রাতে সফরের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। ঠিক হয়, সে রাতটা ধর্মশালায় কাটিয়ে পরের দিন সকালেই নামবেন সকলে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বদল যে তাঁদের এমন ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেবে, ভাবেননি কেউই।” ১৯ জনের দলটায় ফিরেছেন শুধু ঋতুর বাবা ও এক মামা।
বাকিরা হারিয়ে গেলেন কী ভাবে?ঘটনাটা বাবার মুখ থেকে একটু একটু করে শুনেছেন ঋতু। বলেন, “১৭ জুন সকাল ৬টা ৫০ নাগাদ বিকট এক শব্দ শোনেন সকলে। দেখেন প্রবল জলস্রোত নামছে ওপর থেকে। তার সঙ্গে নেমে আসছে হাতির মাপের পাথর। ধর্মশালার সামনেও ভেঙে পড়ছে বিরাট বিরাট পাথরের চাঁই। তার ঘায়ে দেখতে দেখতে চুরমার হয়ে যায় ধর্মশালার দরজা-জানলা। হুহু করে জল ঢুকে যায় ঘরে। জলের তোড়ে একে একে ভেসে যেতে থাকেন সবাই।”
কী ভাবে বাবার হাত ছেড়ে মা ভেসে গেলেন, বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন কুসুমদেবীর মেয়ে। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে চোখ মুছে বলেন, “মায়ের হাত ধরে আটকাতে গিয়েছিলেন বাবা। কিন্তু হাতটা ধরে রাখতে পারেননি। জলের প্রচণ্ড স্রোত এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় মা-কে। বাবার চোখের সামনেই।”
কুসুমের দুই বোন, তাঁদের স্বামীরা ও তিন শিশু-কে ভেসে যেতে দেখেছেন বিনোদবাবু। শ্যালক সুরজরতন রাঠি ছাড়া আর কারওকে খুঁজে পাননি তিনি। ধর্মশালার পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে কী ভাবে যে শালা-ভগ্নিপতি হেলিপ্যাডে পৌঁছলেন, আজ আর মনেই করতে পারছেন না বিনোদবাবু। স্রেফ জল আর ভিজে বিস্কুট খেয়ে তিন দিন সেখানে অপেক্ষা করেন দু’জনে। আর খুঁজে ফেরেন নিজের আত্মীয়দের। ঋতু বলেন, “বাবা বলছিলেন, ওই তিনটে দিন যেন তিনটে বছর মনে হচ্ছিল তাঁদের। তার পরে সেনারা এসে তাঁদের হেলিকপ্টারে তোলেন। ফিরে আসেন তাঁরা। বাকিদের আজও খোঁজ নেই।”
ঋতু বলেন, “আমরা উত্তরাখণ্ড সরকারের ওয়েবসাইট ঘেঁটেছি। সেখানে কুসুম বলে এক জনের নাম দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কত তাঁর বয়স, কী-ই বা ঠিকানা কিছুই লেখা নেই। ভীষণ অসহায় লাগছে।”
ভেসে যাওয়া স্ত্রীর হাতটা কিছুতেই যে কেন ধরে রাখতে পারলেন না এই আফশোসই কুরে কুরে খাচ্ছে বিনোদবাবুকে। কথাবার্তা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছেন। নাওয়া-খাওয়াও। চোখ দিয়ে শুধু জল গড়িয়ে পড়ছে। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না মেয়ে ঋতু। |