প্রথম বছর মহাকরণের অলিন্দেই ছবি এনে মালা দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় বছর ৮ জুলাই ছিল রবিবার। তাই দু’দিন আগেই বিধানসভার লবিতে জন্মদিন পালন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃতীয় বছর বিধানসভার অনুষ্ঠান রীতি মেনেই হয়েছে। কিন্তু শততম জন্মদিনে তাঁর সাড়ে তেইশ বছরের কর্মক্ষেত্র মহাকরণে ফিরলেন না প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু।
এবং পরেও আর ফিরবেন কি না, সংশয় থাকল।
এই ঘটনায় প্রশ্ন উঠল, তা হলে প্রথম বারেই বা জন্মদিন পালিত হল কেন? সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, বিধানচন্দ্র রায় ছাড়া আর কোনও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর জন্মদিন মহাকরণে পালন করা হবে না বলে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হয়েছে। এক প্রশাসনিক কর্তা বলেন, “বাম সরকারের আমলে মনীষীদের জন্মদিনে মহাকরণে ঘটা করে মাল্যদানের চল ছিল না। নতুন সরকার আসার পরে এই রীতি চালু হয়েছে।” তাঁর কথায়, “প্রতি বছরই অবশ্য তালিকা পাল্টে যায়। যেমন, ২০১১ সালে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ও প্রফুল্ল সেনের জন্মজয়ন্তী পালিত হয়েছিল। কিন্তু ২০১২ থেকে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শুধু বিধানচন্দ্র রায়ের জন্মদিন পালন করা হচ্ছে।” |
এখানেই হয় মাল্যদান অনুষ্ঠান। সোমবার ফাঁকা। মহাকরণে। —নিজস্ব চিত্র |
গত বছর থেকেই সরকারি উদ্যোগে বসুর জন্মদিন পালন নিয়ে উষ্মা তৈরি হয় বামেদের মনে। মুখ্যমন্ত্রী দু’দিন আগে বিধানসভার লবিতে জন্মদিন পালন করায় তার প্রতিবাদ করেছিলেন তাঁরা। অনুষ্ঠান বয়কটও করেছিলেন। পরে ৮ জুলাই তাঁরা বিধানসভার গেটে বসুর ছবি বেঁধে জন্মদিন পালন করেন।
এ বার অবশ্য স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় বিধানসভায় অনুষ্ঠানের জন্য সকলকে আমন্ত্রণ জানান। সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন শাসক ও বিরোধী, দু’পক্ষই। তবে সেখানেও চমক। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতা উল্লেখ করেন। যা শুনে অনেকেরই প্রশ্ন, বসু-স্মরণের মাধ্যমে কি দলকেই কোনও বার্তা দিতে চাইলেন তিনি?
তবে বিধানসভার এই অনুষ্ঠান মহাকরণ-বিতর্ককে থামাতে পারেনি। মাল্যদানের সাম্প্রতিক সূচি খতিয়ে দেখলে দেখা যাচ্ছে, তাতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে ভানু ভক্ত, আছেন অনেকেই। শুধু জন্মদিনই নয়, আগামী ২৪ জুলাই উত্তমকুমারের মৃত্যুদিন পালিত হবে বলেও ঠিক রয়েছে। মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি জন্মদিনে শুভেচ্ছা-সৌজন্যও বহাল রেখেছে সরকার। এ দিনই ছিল প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেট অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন। তাঁকে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
এই প্রেক্ষিতে কোনও কোনও মহলে প্রশ্ন, শতবর্ষে মহাকরণে বসুর ছবি রেখে শ্রদ্ধা জানানোর ব্যবস্থা করলে কী এমন অসুবিধা হত?
এই জায়গা থেকেই প্রশ্ন তুলেছেন বামেরা। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিমের কথায়, “মহাকরণে নানা ক্ষেত্রের ব্যক্তিত্বদের জন্মদিন পালনের সিদ্ধান্ত বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীরই নেওয়া। তার জন্য নতুন সরকারের গোড়ার দিকে মুখ্যমন্ত্রীর সৌজন্য বোধ নিয়ে কত চর্চা হয়েছিল! কিন্তু দেখাই যাচ্ছে, তিনি বিবেক-বর্জিত আনুষ্ঠানিকতা চালিয়েছেন শুধু।” সিপিএমের বক্তব্য, বসুর জন্মদিন বা শতবর্ষ কী ভাবে সরকার পালন করবে, বা আদৌ করবে কি না, তা নিয়ে তারা কোনও দাবি জানাতে যায়নি। সেই কথা মনে করিয়েই সেলিমের মন্তব্য, “জ্যোতিবাবুর জন্মদিন বাদ রাখার সিদ্ধান্ত সচেতন ভাবেই নেওয়া। তবে এতে জ্যোতিবাবুকে ছোট করা যাবে না!” জ্যোতিবাবুর সঙ্গে তাঁদের প্রবল রাজনৈতিক বৈরিতার কথা উল্লেখ করেও মহাকরণে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর জন্মদিন পালন না-করার সিদ্ধান্তে কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের কটাক্ষ, “কোনও সুস্থ, স্বাভাবিক ব্যক্তির কাছে এ সব প্রত্যাশা করি না। কিন্তু এই সরকারের দিক থেকে এটা অপ্রত্যাশিত নয়! মুখ্যমন্ত্রী নিজেই তো কারও প্রতি সম্মান, সৌজন্য দেখাতে জানেন না!”
পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রর ব্যাখ্যা, “শেষ সময়ে বসুর শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতে মমতাই যান। বসুর স্ত্রী মারা যাওয়ার পরেও শ্মশানে যান তিনি। বসুকে যে মুখ্যমন্ত্রী সম্মান করেন, সেটা বোঝাতে আলাদা করে তাঁকে আর প্রমাণ দিতে হবে না!”
|
দিন পালন |
আগে পাঁচ |
পরে পাঁচ |
২৬ জুন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
২৭ জুন রাহুলদেব বর্মন
২৯ জুন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, প্রশান্ত মহলানবিশ
১ জুলাই বিধানচন্দ্র রায়
৬ জুলাই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় |
১৩ জুলাই ভানু ভক্ত
১৯ জুলাই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
২৪ জুলাই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
২ অগস্ট প্রফুল্লচন্দ্র রায়
৪ অগস্ট কিশোর কুমার |
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী
বিধানচন্দ্র রায় ছাড়া শুধু ২০১১ সালে প্রফুল্ল সেন ও জ্যোতি বসুর জন্মদিন পালন।
প্রফুল্ল ঘোষ, অজয় মুখোপাধ্যায় ও সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় বরাবরই ব্রাত্য। |
সব ক’টি অনুষ্ঠানই মহাকরণে |
|
মহাকরণের কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, গত শনিবারই ছিল আরএসএসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিন। ওই দিন মহাকরণে তাঁর ছবি টাঙানো হলেও মুখ্যমন্ত্রী বা অন্য কোনও মন্ত্রী মাল্যদান করেননি। মহাকরণের একটি সূত্রের ব্যাখ্যা, বিজেপি-র কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেই এই সিদ্ধান্ত।
পশ্চিম মেদিনীপুরে থাকায় বিধানসভা বসু-স্মরণেও ছিলেন না মুখ্যমন্ত্রী। স্পিকার বিমানবাবু জানান, প্রচার থাকায় আসতে পারছেন না বলে মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে ফোন করেন। রাজ্যের স্বার্থে বসুর মুখ্যমন্ত্রিত্বে কী ভাবে বহু বার ঐকমত্যের ভিত্তিতে সর্বদলীয় প্রস্তাব পাশ হয়েছিল, বলেন স্পিকার। লোকসভা-বিধানসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় ও হাসিম আব্দুল হালিম সংসদীয় রাজনীতিতে বসুর ভূমিকার কথা বলেন। আধুনিকমনস্ক জ্যোতিবাবুর মনে ‘প্যাঁচ’ ছিল না, বলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র।
সরকারের তরফে বিধানসভায় ছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবাবু কী ভাবে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেন, সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম-পর্বে কী ভূমিকা ছিল তাঁর, তা বলার ফাঁকেই পার্থর মন্তব্য, “দলের সৈনিক ছিলেন। দলের ঊর্ধ্বে উঠতে পারলেন না কেন, মাঝেমাঝে খটকা লাগে!” অনুষ্ঠানে তৃণমূল সাংসদ সৌগতবাবু বলেন, “কক্ষের মধ্যে ওঁকে কত আক্রমণ করেছি। ‘অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র’, ‘রিক্ত শাজাহান’ কত কটূ কথা বলেছি। বাইরে কিন্তু উনি একই রকম ভাল ব্যবহার করেছেন আমাদের সঙ্গে।” সমালোচনা শুনব না, বিধানসভায় প্রশ্নের জবাব দেব না এ সব বসুর মধ্যে দেখিনি, মূল্যায়ন সৌগতবাবুর।
যা শুনে বিধানসভায় উপস্থিত বিধায়কদের কারও কারও প্রশ্ন, বসু-স্মরণের মোড়কে আসলে কি নিজের দলের সরকারের আচরণকেই খোঁচা দিলেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ?
|