বিধানসভায় তাণ্ডবে রায় হাইকোর্টের
আক্রান্ত বিধায়ক যেতে পারবেন পুলিশে
রাজ্য বিধানসভার ভিতরে যাঁরা তাঁর উপরে হামলা করেছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে পারবেন সিপিএম বিধায়ক গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায়।
গত ১১ ডিসেম্বর রাজ্য বিধানসভায় দু’পক্ষের গোলমালে আহত হন বর্ধমানের পাণ্ডবেশ্বরের সিপিএম বিধায়ক গৌরাঙ্গবাবু। তাঁর মাথার খুলিতে চিড় ধরেছিল। পরবর্তী কালে দিল্লির এইমস-এ চিকিৎসা হয় ওই সিপিএম বিধায়কের। রাজ্য বিধানসভার স্পিকার তাঁর উপরে ওই আক্রমণের ঘটনায় কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ায় হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন গৌরাঙ্গবাবু। সোমবার কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত জানিয়ে দিলেন, হামলাকারীদের বিরুদ্ধে গৌরাঙ্গবাবু পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন।
গৌরাঙ্গবাবুর আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য এ দিন আদালতকে বলেন, স্পিকার এই আক্রমণের পরেও নীরব। এক জন আক্রান্ত এবং আহত মানুষ বিচার পেলেন না। রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চট্টোপাধ্যায় সওয়াল করেন, বিধানসভার ভিতরে কোনও ঘটনা ঘটলে কেবল স্পিকারই তার বিচার করতে পারেন। আদালতও তার বিচার করতে পারে না। সংবিধানের ২১২ ধারার ১ নম্বর উপধারা উল্লেখ করে বিচারপতি দত্ত তাঁর রায়ে বলেন, ওই ধারা অনুযায়ী স্পিকারের ভূমিকার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তার ভিত্তিতেই তিনি ওই নির্দেশ দিয়েছেন।
ঘটনার দিন এসএসকেএম হাসপাতালে আহত গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায়।— ফাইল চিত্র
সংবিধানের ২১২ ধারার ১ নম্বর উপধারায় বিধানসভার স্বাভাবিক দৈনন্দিন কার্যপ্রণালীর (প্রসিডিংস) ক্ষেত্রে স্পিকারই শেষ কথা। তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ত্রুটিবিচ্যুতি সংক্রান্ত অভিযোগ তুলে আদালতে যাওয়া যাবে না। কিন্তু রায়ে বলা হয়েছে, এক জন বিধায়ককে অন্য বিধায়করা আক্রমণ করছেন, এটা বিধানসভার স্বাভাবিক দৈনন্দিন কার্যপ্রণালীর মধ্যে পড়ে না। তাই এমন ঘটনা ঘটলে পুলিশ হস্তক্ষেপ করতেই পারে। এই যুক্তিতেই বিধায়ক গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায় পুলিশের কাছে তদন্ত ও বিচারের জন্য অভিযোগ দায়ের করতে পারেন।
বিচারপতির বক্তব্য, এক জন ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছেন, আহত হয়েছেন। তিনি কোথায় ছিলেন, বিধানসভার ভিতরে না বাইরে, সেটা বড় কথা নয়। তিনি মারাও যেতে পারতেন। তিনি যদি খুন হলেও কি পুলিশ মামলা করত না? তাই আক্রান্ত ও আহত হওয়াটাই মূল বিষয়, ঘটনাস্থল নয়। যিনি আক্রান্ত, তিনি বিচার চাইতেই পারেন। এটা তাঁর অধিকার।
এ দিনের এই রায়ের প্রেক্ষিতে গৌরাঙ্গবাবু অভিযোগ দায়ের করলে পুলিশ তদন্ত করে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে পারে। পুলিশ যদি নিষ্ক্রিয় থাকে, তা হলে গৌরাঙ্গবাবু হাইকোর্টে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে মামলা করতে পারবেন। অন্য দিকে, সরকার মনে করলে এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে ডিভিশন বেঞ্চে মামলা করতে পারে।
এ দিন কলকাতা হাইকোর্ট যখন এই রায় দিচ্ছে, তখন চিকিৎসার জন্য গৌরাঙ্গবাবু দিল্লির এইমস-এ। দিল্লিতে যোগাযোগ করা হলে ওই বিধায়ক বলেন, “হাইকোর্ট যে নির্দেশ দিয়েছে, সেই মতো আমি অভিযোগ দায়ের করব। তবে কার বিরুদ্ধে করব, তা বলব না। সবাই জানেন কারা এই ঘটনায় জড়িত ছিলেন। সবাই সব কিছু দেখেছেন।” গৌরাঙ্গবাবু বলেন, “ঘটনার বিহিত চেয়ে স্পিকারকে আমি চিঠি দিয়েছিলাম। তার জবাব পাইনি। দু’বার স্পিকার আমাকে ডেকে আমার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিয়েছিলেন। কিন্তু আমার চিঠির জবাব এখনও পাইনি।”
হাইকোর্টের এ দিনের রায়ের প্রেক্ষিতে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “রায় না দেখে আমি কোনও মন্তব্য করব না।” বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও আদালতের রায় না দেখে কোনও মন্তব্য করবেন না বলে জানিয়েছেন। পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “বিচারপতি কী বলেছেন জানি না, কিন্তু বিধানসভার নিয়মাবলি মেনেই সভা পরিচালিত হয়। সেখানে স্পিকারই শেষ কথা। এটাই এত দিন জেনে এসেছি। এখন আদালত কী রায় দিয়েছে, তা না জেনে বিশদে কিছু বলতে পারব না।”
সম্প্রতি একের পর এক মামলায় আদালতের রায়ে অস্বস্তি বেড়েছে রাজ সরকারের। এ দিনের রায় সেই তালিকায় নতুন সংযোজন। এ দিন হাইকোর্টের রায় জানার পরে তৃণমূলের পরিষদীয় দলের একটি সূত্র ইঙ্গিত দিয়েছে, যদি দেখা যায় ওই রায়ে স্পিকারের এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, তা হলে বিধানসভার অধিকারভঙ্গের অভিযোগ তোলা যেতে পারে। আবার অ্যাডভোকেট জেনারেলকে বলা হতে পারে, ওই রায়ের বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চে আপিল করতে। হাইকোর্টের রায় পর্যালোচনা করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে সূত্রটি জানান। রাজ্যের প্রাক্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিম অবশ্য হাইকোর্টের রায়কেই সমর্থন করেছেন। তিনি বলেন, “হাইকোর্ট ঠিকই রায় দিয়েছে। কারও উপরে যদি হামলা হয়, তা হলে তিনি সব সময়েই পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে পারেন। তা সে যেখানেই হোক না কেন।
গৌরাঙ্গবাবুর পক্ষ থেকে হাইকোর্টে যে মামলা দায়ের করা হয়েছিল, তাতে এসএসকেএম হাসপাতালের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনা হয়েছিল। বিধানসভায় আহত হওয়ার পরে গৌরাঙ্গবাবুকে এসএসকেএম হাসপাতালে আনা হয়। সেখানে সিটি স্ক্যান করে গুরুতর কিছু না পাওয়া যাওয়ায় তাঁকে ভর্তি না করেই ছেড়ে দেওয়া হয়। অথচ বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর মাথার খুলিতে চিড় ধরা পড়ে। আদালতের কাছে আবেদনে গৌরাঙ্গবাবু এসএসকেএম হাসপাতালের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ আনার অনুমতিও চেয়েছিলেন। তাঁর আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য বলেন, এসএসকেএম হাসপাতাল যা করেছে, তা চিকিৎসায় গাফিলতির সামিল।
বিচারপতি দত্ত তাঁর রায়ে বলেন, গৌরাঙ্গবাবু যদি মনে করেন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার গাফিলতি হয়েছে, তা হলে তাঁকে যথাস্থানে (মেডিক্যাল কাউন্সিল বা ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে) আবেদন করতে পারেন। সেখানে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরেও যদি সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়, তখন হাইকোর্টে আবেদন করা যাবে।
হাইকোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে গৌরাঙ্গবাবু বলেন, “শাসক দলের যে বিধায়কেরা আমাকে মারধর করেছিলেন, তাঁরাই প্রমাণ লোপাটের জন্য এসএসকেএম হাসপাতালকে চিকিৎসা না করার নির্দেশ দেন।” কী হয়েছিল গত বছরের ১১ ডিসেম্বর? ওই দিন রাজ্য বিধানসভায় রাজ্যে বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা নিয়ে আলোচনার দাবিতে মুলতুবি প্রস্তাব আনেন বামফ্রন্টের বিধায়কেরা। কিন্তু স্পিকার আলোচনার সুযোগ না দেওয়ায় বাম বিধায়কেরা স্পিকারের আসনের সামনে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। তখনই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সভা। সিপিএম বিধায়ক দেবলীনা হেমব্রম এবং তৃণমূলের মেহমুদা বেগম মুখোমুখি হয়ে ধাক্কাধাক্কিতে জড়িয়ে পড়েছেন দেখে তাঁদের সামলাতে এগিয়ে যান পাণ্ডবেশ্বরের সিপিএম বিধায়ক গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায়। দেবলীনাকে তুলে আছাড় মারা হয়। সেই গণ্ডগোলের মধ্যেই মন্ত্রীদের বসার জায়গায় মুখ থুবড়ে পড়েন গৌরাঙ্গ। মাথায় চোট পান তিনি।
গৌরাঙ্গবাবুকে নিয়ে যাওয়া হয় এসএসকেএম হাসপাতালে। মাথার চোট পরীক্ষা করার জন্য সিটি স্ক্যানও করা হয়। কিন্তু আঘাত গুরুতর নয় বলে এসএসকেএম হাসপাতাল তাঁকে ভর্তি করাতে চায়নি। পরে তাঁকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ওই বেসরকারি হাসপাতাল গৌরাঙ্গবাবুর যে সিটি স্ক্যান করেছিল, তাতে তাঁর মাথায় চিড় ধরা পড়ে। পরে নয়াদিল্লির এইমস-এ তাঁর চিকিৎসা হয়। চেক-আপের জন্য এখনও গৌরাঙ্গবাবুকে ছুটতে হচ্ছে দিল্লিতে।
এক জন ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছেন, আহত হয়েছেন। তিনি কোথায় ছিলেন, বিধানসভার ভিতরে না বাইরে, সেটা বড় কথা নয়। তিনি যদি খুন হতেন, তা হলেও কি পুলিশ মামলা করত না? যিনি আক্রান্ত, তিনি বিচার চাইতেই পারেন।
দীপঙ্কর দত্ত, বিচারপতি
রায় না দেখে মন্তব্য করব না।
বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়, স্পিকার
কারও উপরে হামলা হলে তিনি সব সময়েই পুলিশে অভিযোগ করতে পারেন।
হাসিম আব্দুল হালিম, প্রাক্তন স্পিকার
বিধানসভায় স্পিকারই শেষ কথা। এটাই এত দিন জেনে এসেছি। এখন আদালত কী রায় দিয়েছে, না জেনে বিশদ বলতে পারব না।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়, পরিষদীয় মন্ত্রী
হাইকোর্ট যে নির্দেশ দিয়েছে, সেই মতো অভিযোগ দায়ের করব।
গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায়, সিপিএম বিধায়ক
২১২ ধারা
আইনসভার কাজকর্মে নাক গলাবে না আদালত পদ্ধতিগত ত্রুটিবিচ্যুতির অভিযোগ এনে বিধানসভার স্বাভাবিক দৈনন্দিন কার্যপ্রণালী (প্রসিডিংস) নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না।

পুরনো খবর:
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.