বিভীষিকার ভ্রমণ সেরে দেবভূমি গঢ়বাল থেকে ঘরে ফিরেছেন কেউ,
অনেকেই ফেরেননি। তাঁদের নিয়েই ধারাবাহিক প্রতিবেদন। |
বাঁকুড়া শহরের পুরনো রসিকতা কোন বাড়ির দরজা কখনও বন্ধ হয় না?
অ্যাডভোকেট ব্রজবাসী বিশ্বাসের বাড়ির!
বড় বড় থামওলা সেকেলে বাড়িটার সদর এখনও হাট করে খোলা। থানা পেরিয়ে একটু এগিয়ে রাস্তা থেকেই চোখে পড়ে, ঘর ভর্তি থাক-থাক বইপত্র। শুধু বইয়ের মালিকই নেই।
ফৌজদারি আদালতের দুঁদে উকিল ব্রজবাবু জেলা কংগ্রেসের সভাপতিও। কিন্তু সবর্জনপ্রিয়তার কাছে গোহারান হেরে গিয়েছে তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়ও। ব্রজবাবু বলতেন, “থানার দরজা কি কখনও বন্ধ হয়! আমার বাড়ির দরজাও মানুষের জন্য
সব সময়ে খোলা!” বলেছেন এই সে-দিন পর্যন্তও।
তিন সপ্তাহ হতে চলল, সেই মানুষটাই উধাও।
বাঁকুড়া জেলা আদালত-চত্বর থেকে মাচানতলার জমজমাট বাজার, মোড়ের চায়ের দোকান থেকে ডান-বাম পার্টিঅফিস সর্বত্র কান পাতলে একটাই আলোচনা ঘুরে-ফিরে আসছে, “অমন ডাকাবুকো লোকটা বেমালুম হারিয়ে গেলেন? আশ্চর্য!”
স্ত্রী মনিকাদেবীকে নিয়ে ১১ জুন আসানসোল থেকে ট্রেনে উঠেছিলেন ব্রজবাবু। গন্তব্য চার ধাম কেদার, বদ্রী, গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রী। ১৬ জুন দুপুরে ছেলের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। ব্রজবাবু তখন কেদারনাথে, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের অতিথিনিবাসে। গলাটা একটু কাহিল শোনাচ্ছিল। বললেন, “জ্বর-জ্বর লাগছে। প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বেগতিক বুঝলে মন্দিরে থেকে যাব!” |
সেই শেষ কথা। ব্রজবাবুর পুত্র, কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী পদ্মনাভ বিশ্বাস তার পরে বহু বার বাবার নম্বরে ফোন করেছেন। সাড়া মেলেনি। মা-বাবার আর কোনও খোঁজ তিনি পাননি। প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দীপা দাশমুন্সি পর্যন্ত যাবতীয় যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে মাঠে নেমেছেন পদ্মনাভ। কেদারনাথে উদ্ধারকাজে ব্যস্ত অফিসারদের কাছেও ব্রজবাবু ও মনিকাদেবীর ছবি পাঠিয়েছেন। কিন্তু লাভ হয়নি।
বাঁকুড়া থেকে একই সময়ে কেদার গিয়েছিলেন আরও অনেকে। তাঁরা কেউ কেউ ফিরেছেন। ব্রজবাবুদের নিয়ে নানা জল্পনা বাতাসে ভাসছে। কেউ বলছেন, মধ্য-ষাটের ব্রজবাবুই কেদারের মন্দিরে আশ্রয় নেওয়া বিপন্ন মানুষের পরিচর্যায় এগিয়ে এসেছিলেন। কেউ বা শুনেছেন, মনিকাদেবী মন্দিরের গর্ভগৃহে ঠাঁই পেয়েছিলেন, কিন্তু স্বামীকে খুঁজতে বেরিয়ে আসেন। পদ্মনাভ আশায় বুক বাঁধছেন, কে জানে, এমনও তো হতে পারে বাবা-মা হয়তো কোথাও আটকে রয়েছেন। এখনও তো উত্তরাখণ্ডে দুর্গতরা সবাই উদ্ধার হননি!
রাজ্য বার কাউন্সিলের সহ-সভাপতি ব্রজবাবু অনেক বাঁকুড়াবাসীর কাছেই গর্বের মানুষ। পঞ্চায়েত ভোটের মুখে জেলা সভাপতির অনুপস্থিতিতে দল যে অভিভাকহীন হয়ে পড়েছে, শুক্রবার তা স্বীকার করে নিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। ছাতনায় নির্বাচনী সভায় যাওয়ার পথে তিনি ঘুরে যান ব্রজবাবুর বাড়ি। পদ্মনাভর সঙ্গে দেখা করেন।
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি বলেন, “কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ব্রজবাবুকে খুঁজে বার করার সব রকম চেষ্টা চালাচ্ছেন। আমরা নিশ্চিত, ওঁকে খুঁজে পাবই।”
জেলার কংগ্রেস নেতা আইনজীবী অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলছেন, “যত বড় বিপদই আসুক, লড়াকু ব্রজদা হেরে যাবেন কিছুতেই ভাবতে পারছি না। হয়তো হুট করে একদিন হাসতে হাসতে বউদিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসবেন। কিংবা আচমকা কোর্টে ঢুকে সবাইকে চমকে দেবেন!”
উৎকণ্ঠা ছাপিয়ে এই বিশ্বাসটুকুই এখন ভরসা।
|