বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের চারটি ব্লকেই শাসকদলকে সমানে টক্কর দিতে তৈরি বামেরা। জেলার বিষ্ণুপুর মহকুমার বিভিন্ন এলাকায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে সিপিএম সন্ত্রাসের অভিযোগ তুললেও, জঙ্গলমহলে ছবিটা অন্য। এখানে যেন সৌহাদ্যের পরিবেশেই শাসক-বিরোধী দু’পক্ষ যুদ্ধে নেমেছে।
বাঁকুড়া জেলার ১৯০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ২৫০৫টি আসনের মধ্যে ৫৪৭টি ও ২২টি পঞ্চায়েত সমিতির ৫৩৫টি আসনের মধ্যে ১১০টি আসনে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হচ্ছে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গিয়েছেন তৃণমূলের প্রার্থীরা। বিনা লড়াইয়ের বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটেছে মূলত বিষ্ণুপুর মহকুমা এলাকায়। অতীতেও একই রকম হত। তখন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততেন সিপিএমের প্রার্থীরা। কিন্তু বরাবরের মতো জঙ্গলমহলে ভোটের লড়াইয়ের ছবিটা একই থেকে গিয়েছে।
গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে সারেঙ্গা ব্লকের ৮০টি আসনের মধ্যে শুধু মাত্র একটি আসন ছাড়া জঙ্গলমহলের সিমলাপাল (১০৫টি আসন), রাইপুর (১৩১টি আসন) ও রানিবাঁধ ব্লকের (৯০টি আসন) প্রত্যেকটি আসনেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়ছে বামেরা। এমনকী পঞ্চায়েত সমিতি স্তরেও সারেঙ্গা (১৮টি আসন), সিমলাপাল (২১টি আসন), রাইপুর(২৯টি আসন) ও রানিবাঁধ(২১টি আসন) ব্লকের প্রত্যেক আসনেই তৃণমূল ও বামেদের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন পর্ব শুরু হওয়ার পর থেকেই জেলায় জেলায় সন্ত্রাস চালিয়ে বিরোধীদের প্রার্থী দিতে না দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে শাসকদলের বিরুদ্ধে। একই ঘটনা ঘটেছে বাঁকুড়াতেও। জয়পুর ব্লকের পঞ্চায়েত সমিতির ২৫টি ও গ্রামপঞ্চায়েতের ১১৬টি আসনে বিরোধী প্রার্থী না থাকায় জয়লাভ করেছে তৃণমূল। বিষ্ণুপুর, কোতুলপুর, পাত্রসায়র ব্লকেও অর্ধেকের বেশি আসন বিরোধী শূন্য। সব ক্ষেত্রেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে জঙ্গলমহলের চারটি ব্লকে শাসকদলের বিরুদ্ধে সবকটি আসনেই লড়াই করার রসদ বামেরা পেল কোথা থেকে?
সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য তথা সিমলাপাল পঞ্চায়েত সমিতির বিদায়ী সভাপতি সুবীর পাত্র বলেন, “এখানে রাজনৈতিক সন্ত্রাস বলে কিছু নেই। তৃণমূল, সিপিএম বা কংগ্রেস সব দলের নেতারাই এক চায়ের দোকানে বসে আড্ডা মারি। একে অন্যের ডাকে ছুটে যাই।” সিমলাপালের বাসিন্দা তৃণমূলের অন্যতম জেলা সাধারণ সম্পাদক দিলীপ পণ্ডা বলেন, “রাজনীতি করার অধিকার সকলেরই আছে। সিমলাপালে রাজনৈতিক হিংসা কখনওই ছিল না। থাকবেও না।” সারেঙ্গাতেও রাজনৈতিক সন্ত্রাস কার্যত নেই বলেই মেনে নিয়েছএন সিপিএমের জোনাল কমিটির সম্পাদক অজিত চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “আমরা প্রার্থী নির্বাচন করতে গিয়ে বা প্রচার করতে গিয়ে কোথাও বাধা পায়নি। দু’একটি জায়গায় কিছু তৃণমূল কর্মী হম্বিতম্বি করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। তৃণমূলের ব্লক নেতারাই ওদের থামিয়ে দিয়েছে।” সারেঙ্গার ব্লক তৃণমূল সভাপতি ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষও বলেন, “বাম আমলে সারেঙ্গার কিছু এলাকায় সন্ত্রাস চলেছে, খুনোখুনিও হয়েছে। কিন্তু আমরা এর বদলা নিতে চাই না।”
রাইপুরেও রাজনৈতিক হানাহানি কম বলেই স্বীকার করেছেন সিপিএমের রাইপুর জোনাল কমিটির সম্পাদক ধ্রুবলোচন মণ্ডল। তিনি বলেন, রাইপুরে যাঁরা আদি তৃণমূল, তাঁরা সন্ত্রাস চান না। কিন্তু সম্প্রতি অন্য দল থেকে তৃণমূলে যোগ দেওয়া নব্য তৃণমূলীরা কিছু এলাকায় সন্ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। যদিও প্রকৃত তৃণমূলীরা এর প্রতিবাদ করে চলেছেন।” তবে এলাকার বাম প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে বা প্রচারে নেমে এখনও কোনও বাধার সামনে পড়তে হয়নি বলে তিনি জানিয়েছেন।
রাজনীতির কারবারিরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, গত বিধানসভা নির্বাচনে পরিবর্তনের ঝড়ের দাপটে রাজ্যজুড়ে ওলটপালট হয়ে গেলেও বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলে সিপিএমের মাটি কিন্তু টলেনি। জেলার মধ্যে শুধু রাইপুর, সারেঙ্গা ও তালড্যাংরা বিধানসভা কেন্দ্রই সিপিএম ধরে রাখতে পারে। তাই ওইসব এলাকায় এখনও সিপিএমের বিশেষ প্রভাব রয়েছে। এক সিপিএম কর্মীর মন্তব্য, “জেলার অন্যত্র যাই হোক, এখানে বিনা লড়াইয়ে আমরা সূচ্যাগ্র মেদিনী ছাড়ছি না।” |