কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পরীক্ষার্থীরা নিশ্চয়ই আগে বোঝেন নাই যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সঙ্গে তাঁহাদের ভাগ্য এমন নির্মম পাকে জড়িত। অথচ তাঁহাদের পরীক্ষার প্রস্তুতি, পরীক্ষার সময়সূচি এবং সম্ভবত পরীক্ষার ফলাফলেও চিরন্তন ছাপ রাখিয়া গেল ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোট। এ বার যাঁহারা পার্ট-ওয়ান পরীক্ষা দিতে চলিয়াছেন, তাঁহারা যে সাকুল্যে তৃতীয় বর্ষের পাঠ্যক্রমটি পড়িয়াই উঠিতে পারিবেন না, ওই বর্ষের জ্ঞাতব্যাদি বাদ দিয়াই যে তাঁহারা স্নাতক হইয়া যাইবেন, তাহাতে কেহ আর বিস্মিত হইবেন না, কেননা সকলেরই মনে পড়িয়া যাইবে, ওঃ, তাই তো, ২০১৩ সালের পরীক্ষার্থীদের নিকট কী ভাবেই-বা ইহার অধিক আশা করা যায়! ইতিমধ্যে দুই-দুই বার স্নাতক পার্ট-ওয়ান ও পার্ট-টু পরীক্ষাসূচির রদবদল হইয়াছে, জুন হইতে শেষ-অগস্টে গিয়া পৌঁছাইয়াছে। পঞ্চায়েতের সহিত পরীক্ষার কী সম্পর্ক? জলের মতো সহজ। যাহারা ভোট দিবে, তাহারা কী করিয়া পরীক্ষা দিবে? যাহারা ভোটের বন্দোবস্ত করিবে, তাহারা কী করিয়া পরীক্ষা লইবে? যেখানে ভোট হইবে, সেখানে কী উপায়ে পরীক্ষার সিট পড়িবে? যুক্তি বহু প্রকার ও অতি অকাট্য!
লক্ষণীয়, রক্ষী-বাহিনী হইতে রমজান, নানা হেতুতে পঞ্চায়েত ভোটের সময় লইয়া এত বিস্তারিত বিতর্কের মধ্যে পরীক্ষার বিষয়টি কিন্তু কখনও গুরুত্ব পায় নাই। দেড় লক্ষাধিক ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ ইহার সহিত যুক্ত, কিন্তু কোটি মানুষের ভোটের পাশে দেড় লক্ষ নিতান্ত এলেবেলে: ইহাই নিশ্চয় সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি। নতুবা, পঞ্চায়েত ভোটের সূচি যখন ২ বা ৪ জুলাই ধার্য ছিল, তখনও কিন্তু পরীক্ষা পূর্বনির্ধারিত তারিখ ১৮ জুন হইতে সারিয়া লওয়া যাইত, সামান্য কিছু বদল সমেত। বিশেষত পার্ট-ওয়ান পরীক্ষার পরে যখন ছাত্রছাত্রীরা পরবর্তী শ্রেণির পাঠের জন্য সীমিত সময়ই পাইয়া থাকেন, তখন এটুকু সহমর্মিতা কর্তৃপক্ষের নিকট প্রত্যাশিত ছিল। এই মুহূর্তে পূজার আগে তৃতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু করাই অসম্ভব। উপাচার্য যতই সম্মতি দিন, একটি পরীক্ষার শিরে-সংক্রান্তি লহিয়া অন্য শ্রেণির পড়াশোনা সহজ কাজ নহে!
কিছু মৌলিকতর প্রশ্নও উত্তর দাবি করে। স্বাধীন দেশে গণতন্ত্র চালু হইবার সাড়ে ছয় দশক পরও, নির্বাচনের জন্য, এমনকী স্থানীয় নির্বাচনের জন্য, কেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করিয়া, পরীক্ষাব্যবস্থা স্থগিত রাখিতে হইবে? কেন ভোটের জন্য পৃথক পরিকাঠামো নির্মিত হইবে না? প্রশাসন-ব্যবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থার দূরত্ব কেন বজায় রাখা যাইবে না? কেন-ই বা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় এতগুলি কলেজ, এত বিপুল-সংখ্যক ছাত্রছাত্রী থাকিবে যে পরীক্ষার বন্দোবস্ত মাত্রেই তাহা রাজ্যব্যাপী রাজসূয় হইয়া উঠিবে? এই বিশালাকার বপুর জন্য যে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বৎসর বিভিন্ন হেতুতে ছাত্রছাত্রীদের এত দুর্বিপাক ও দুর্ভোগ, তাহা লইয়া সকল স্তরেই দ্রুত নূতন ভাবনা অতীব জরুরি। |