পশ্চিমবঙ্গের মানুষ দেখিয়াছেন যে, বারাসতের কামদুনিতে যে ধর্ষণ-কাণ্ডটি ঘটিয়াছিল, তাহা পাশবিকতার নিরিখে দিল্লি-ধর্ষণের প্রায় সমতুল্য। কিন্তু দিল্লির ক্ষেত্রে যে দ্রুত ও দক্ষ তদন্ত দেখা গিয়াছিল, পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্যে তাহা ঘটিল না। বারাসত আদালতে বিচারপতি অর্পণ চট্টোপাধ্যায় চার্জশিটের একাধিক অসঙ্গতির দিকে নির্দেশ করিয়া সিআইডি-কে বিস্তর ভর্ৎসনা করিয়াছেন। কলিকাতা হাইকোর্ট যে মামলাটির উপর নজরদারির ভার লইল, তাহা সিআইডি তথা রাজ্য প্রশাসনের উপর অনাস্থারই প্রকাশ। চার্জশিট ও কেস ডায়েরির বয়ানে অজস্র ফারাক। অনুমান করিবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, নিরপেক্ষতার প্রয়াস বাতিল হওয়াতেই এই ফারাকের উদ্ভব। যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তদন্ত আরম্ভ হইবার পূর্বেই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিয়া দেন, পোশাক দেখিয়াই মাওবাদী চিনিতে পারেন সেই রাজ্যে পুলিশের নিকট নিরপেক্ষতা ও অবিচলিত কর্মনিষ্ঠা আশা করা শক্ত। কামদুনি-কাণ্ডের পর রাজ্যব্যাপী ক্ষোভ প্রশমিত করিতে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করিয়াছিলেন, ১৫ দিনে চার্জশিট পেশ করা হইবে। কাজেই ফরেন্সিক পরীক্ষার ফলাফল হাতে আসুক আর নাই আসুক, তড়িঘড়ি চার্জশিট পেশ করিবার চাপটি বিলক্ষণ ছিল। সম্ভবত একই সঙ্গে কিছু লোকের উপর অভিযোগের বোঝা লাঘব করিবার চাপও ছিল। কলিকাতা হাইকোর্ট চার্জশিটের যে যে দুর্বলতার দিকে নির্দেশ করিয়াছে, তাহা এই সকল চাপ হইতেই উদ্ভূত হওয়া সম্ভব। সব দিক রক্ষা করিতে গিয়া শেষ পর্যন্ত যাহা আদালতে পেশ হইয়াছে, তাহাতে সংশয় জাগিয়াছে অপরাধীদের যথাযথ শাস্তি হইবে তো?
কামদুনি চার্জশিট অবশ্য কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নহে। একের পর এক ঘটনায় স্পষ্ট: পুলিশ ও প্রশাসনের দায়-দায়িত্ব বোধসমূহ ভিতর হইতে ভাঙিয়া পড়িতেছে। প্রশাসনের নিজস্ব ছন্দটি নষ্ট করিয়া, সমস্ত প্রশাসনের কড়ি-বরগা নাড়াইয়া তাহাতে ব্যক্তিবিশেষের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করিলে এই ভাবেই প্রতিষ্ঠানের সর্বনাশ হয়। প্রশাসক হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে সব প্রতিষ্ঠানের উপর একাধিপত্য চাহিয়াছেন দলীয় একাধিপত্যও নহে, একেবারে ব্যক্তি-একাধিপত্য সেই ক্ষমতার দর্প-দর্শনে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মেরুদণ্ডের জোর ক্রমেই অবলুপ্ত হইতেছে। এই রাজ্যের সবই এখন একক-মুখাপেক্ষী। বাসভাড়া বাড়িবে কি না, পুলিশি তদন্ত কোন পথে যাইবে, কোন মানুষটিকে কোন দলের খোপে পোরা হইবে, সব তিনিই স্থির করিয়া দেন। সাধারণ নিয়মমতে, পুলিশ নিজের কাজ করিবে, পুলিশমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী তাঁহাদের কাজ করিবেন, একে অপরের সহিত সংঘাতের অবকাশ নাই, হস্তক্ষেপেরও নহে। কিন্তু যাহা হওয়া উচিত, আর পশ্চিমবঙ্গে যাহা হইতেছে, তাহাতে কৃষি-শিল্পের ফারাক।
উপরন্তু প্রশাসনের এই একক ব্যক্তিটির কাজেরও শেষ নাই। সভাসমিতি পরিচালনা, চলচ্চিত্র উৎসবের বন্দোবস্ত, কবির শেষযাত্রা পরিচালন সবই তিনি একা হাতে সারেন। সমস্যা হইল, দিনে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টাই সময়। দৃশ্যতই, সময়ের তুলনায় কাজের পরিমাণ বিসদৃশ রকম বেশি। গোটা প্রশাসনের দায়িত্ব যিনি একা সাধিয়া লইয়াছেন সর্ববিধ দায়িত্ব পালনের সময় তিনি পাইবেন কী ভাবে। পশ্চিমবঙ্গের এই সংকটের উপলব্ধি কী ভাবে একেবারে মাটির কাছাকাছি পৌঁছাইয়াছে, তাহার প্রমাণ কামদুনি, যেখানে নিহত ভগ্নির বিচার-প্রক্রিয়া দেখিয়া হতাশ ভ্রাতাও এই প্রশ্ন উচ্চারণ করেন। প্রথমত, প্রশাসনের এই একক মুখ, এবং দ্বিতীয়ত, এই একক মুখের সর্বব্যাপী উপস্থিতি: এই দুই সমস্যার জেরে এই মুহূর্তে রাজ্য এখন চরম বিপদের সম্মুখীন। বিচারবিভাগের বক্তব্যের মধ্যে সেই বার্তাই ধ্বনিত হইতেছে। এখনও সময় আছে, মুখ্যমন্ত্রী যদি প্রশাসনের কাজ প্রশাসনকে করিতে দেন, এবং সর্ব ঘটে নিজে ও নিজের প্রশাসনকে প্রত্যক্ষ ভাবে না জড়াইয়া ফেলেন, বিপদ-মুক্তি হইলেও হইতে পারে। গোটা পৃথিবীতে এই মুহূর্তে ক্ষমতার সীমা লইয়া বিতর্ক-বিদ্রোহের শেষ নাই। নূতন গণতন্ত্র মিশর হইতে তুলনায় পুরাতন গণতন্ত্র তুরস্ক, সকলেই দেখিতেছে, গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করিয়া ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা পুঞ্জীভূত হইলে ফল ভাল হয় না। গণতান্ত্রিক মতে ক্ষমতা অর্জন করিলে গণতান্ত্রিক পথেই তাহা ব্যবহার করা আবশ্যিক। |