বছর পনেরোর আহ্লাদি জন্ম থেকেই অন্ধ। দাদু লাল মহম্মদের কাছেই মানুষ হয়েছে আহ্লাদি। দাদু দিনমজুরি করে কোনও রকমে সংসার টানেন। সেই আহ্লাদি পঞ্চায়েত থেকে দিনে একবার করে খাবার পেত ‘সহায়’ প্রকল্পে। সেই খাবারেই পেট ভরাতেন শারীরিক প্রতিবন্ধী আলম শেখ। কতকটা এক গল্প প্রৌঢ়া আনারবানু বেওয়ারও।
মুশকিলে পড়েছেন নলহাটি ২ পঞ্চায়েত সমিতির বারা ১ পঞ্চায়েত এলাকার ওই সব সহায় সম্বলহীন মানুষ। শুধু মাত্র নলহাটিই নয়, গোটা বীরভূম জুড়েই ওই সব মানুষের চিত্র কতকটা এক। কারণ রাজ্য সরকার থেকে প্রয়োজনীয় টাকা না আসায় বীরভূম জেলায় প্রায় বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে একটি বিশেষ প্রকল্প। যার সরকারি নাম ‘সহায়’। মূলত সহায় সম্বলহীন অক্ষম মানুষদের কাছে একবেলা পুষ্টিকর খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য চালু হয়েছিল ওই প্রকল্প।
খাবার না পেয়ে আহ্লাদিদের রাগ গিয়ে পড়ছে প্রধানদের উপর।
আহ্লাদির ক্ষোভের মুখে নিজেদের বরং অসহায় বলেই মনে করছেন পঞ্চায়েত প্রধানরা। ওই প্রকল্পের ফলে পঞ্চায়েতগুলি অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াতে পারত। এমন মানুষদের মুখে একবেলা খাবার জুটোতে পেরে অন্য রকমের তৃপ্তি পেতেন প্রধানরাও। আজ, তাই শুধু মাত্র টাকার অভাবে সেই প্রকল্প কার্যত ঠান্ডাঘরে চলে যাওয়ার নেপথ্যে প্রধানদের একটা বড় অংশ রাজ্য সরকারের অদূরদর্শতাকেই দায়ী করছেন। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, রামপুরহাট মহকুমায় নলহাটি ১ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির কলিঠা পঞ্চায়েত ১০ মাসের, মুরারই ১ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির ডুমুরগ্রাম পঞ্চায়েত ৮ মাস, নলহাটি ২ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির বারা পঞ্চায়েত ৩ মাস ও রামপুরহাট ১ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির আয়াষ গ্রাম পঞ্চায়েত ৫ মাস ধরে সহায় প্রকল্পের কোনও টাকা পাচ্ছে না। প্রধানদের অভিযোগ, প্রশাসনকে বারবার জানানোর পরও সেই টাকা মেলেনি। যদিও অতিরিক্ত জেলাশাসক (জেলাপরিষদ) বিধান রায়ের দাবি, “আমরা সঠিক সময়ে ইউসি ও নতুন করে চাহিদার চিঠি না পাওয়ায় পুনরায় টাকা বরাদ্দ করা সম্ভব হচ্ছে না।”
কিন্তু সবিতা দাসেরা অন্য কথা বলছেন।
কলিঠা পঞ্চায়েতের ওই প্রধানের পাল্টা দাবি, “আমরা ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউসি ও নতুন বরাদ্দের জন্য আবেদন করেছি। আজও তার উত্তর পাইনি।” এই অবস্থায় সবিতাদেবী একপ্রকার ধরেই নিয়েছেন, প্রকল্প বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাঁর কথায়, “মেলায় (উৎসব) খেলায় (ক্লাবকে অনুদান) সরকার টাকা না দিয়ে যদি এই সব প্রকল্পে টাকা দেয়, তবে মানুষের অনেক বেশি উপকার হয়।” তাঁর সঙ্গে অনেকটাই একমত ডুমুরগ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান হয়রানি মাল, বারা ১ পঞ্চায়েতের প্রধান সৈয়দ এহেসান আলি কিংবা আয়াষ পঞ্চায়েত প্রধান নবকুমার মণ্ডলেরও। বারা ১ সংসদে ওই প্রকল্পে রান্না করতেন হজরা খাতুন। এমনকী তিনিও বলছেন, “রান্না করে যৎসামান্য টাকা পেতাম। কিন্তু অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে ভাল লাগত। অথচ একটা ভাল কাজের জন্য সরকারের কাছে কোনও টাকা নেই!” ফলে ‘সহায়’-এর সহায়তা না পেয়ে সমস্যায় পড়েছে নলহাটি ব্লকের কাদিপুরের মতো পিছিয়ে পড়া গ্রামগুলির আহ্লাদিরা।
গোটা জেলা জুড়েই যে ‘সহায় প্রকল্পে’র এমন বেহাল অবস্থা তা মেনে নিয়েছেন বেশ কয়েকটি ব্লকের বিডিও। প্রধানদের সুরেই দুবরাজপুরের বিডিও কুণাল বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজনগরের বিডিও প্রভাংশু হালদারদেরও দাবি, বরাদ্দ অর্থের ব্যাপারে জেলায় জানানো হলেও বিগত কয়েক মাস ধরে তা পাওয়া যাচ্ছে না। কুণালবাবু বলেন, “জেলার নির্দেশ মেনে প্রতিটি পঞ্চায়েতকে বলা হয়েছিল পঞ্চায়েতের নিজস্ব তহবিল থেকে সম্ভব হলে প্রকল্পটি চালু রাখতে। ব্লকের দশটি পঞ্চায়েত এলাকার মধ্যে মাত্র কয়েকটিতেই চলছে। বাকি সব বন্ধ। যে ক’টি চলছে টাকার অভাবে অচিরেই সেগুলিও বন্ধ হয়ে যাবে।” ত্রাণের চাল দিয়ে প্রকল্পটি কোনও রকমে টিকে রয়েছে রাজনগরের পাঁচটি ব্লকে। রাজনগরের বিডিও-র কথায়, “এ ভাবে আর বেশিদিন চলবে না।” খয়রাশোলে দশটি ব্লকের মধ্যে মাত্র চারটি পঞ্চায়েত এলাকায় ওই প্রকল্প শুরু হলেও বর্তমানে সেগুলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজ্য সরকারের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতর মারফত ওই সরকারি প্রকল্পে অর্থ সাহায্য পাওয়া যায়। আর জেলার যে দফতরের মাধ্যমে অর্থ ব্লকে ব্লকে যায় সেই ডিআরডিসি-র (ডিস্ট্রিক্ট রুরাল ডেভলপমেন্ট সেল) প্রকল্প অধিকর্তা তথা অতিরিক্ত জেলাশাসক (জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক) শ্যামাশিস রায়ও স্বীকার করে নিয়েছেন, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই প্রকল্পে বরাদ্দ অর্থ পাওয়া গেলেও তারপর থেকে আর আসেনি। তিনি বলেন, “অনিয়মিত ভাবে ওই প্রকল্পের বরাদ্দ অর্থ আসে। তবে রাজ্য পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতর মারফত জানা গিয়েছে শীঘ্রই বরাদ্দ টাকা এসে যাবে। দ্রুত সমস্যা মিটবে।” স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, প্রকল্পের এমন অবস্থার নেপথ্যের কারণ হিসেবে বিধানবাবুর সঙ্গে শ্যামাশিসবাবুর ব্যাখার মিল নেই। পঞ্চায়েত টাকা না পাওয়ার যুক্তি হিসেবে একদিকে বিধানবাবু ‘ইউসি’ ও নতুন করে বরাদ্দের আবেদন ঠিক সময়ে না আসার কথা বলছেন। অন্য দিকে, শ্যামাশিসবাবু জানিয়েছেন, বরাদ্দ টাকা নেই। বিধানবাবু অবশ্য বলছেন, “প্রকল্পটি বন্ধ হয়নি। গত ফেব্রুয়ারিতে রাজ্য থেকে ২০ লক্ষ টাকা এসেছিল। আমাদের হাতে এখনও ৩ লক্ষ টাকা আছে।”
সবিতাদেবী ও এহেসান আলিরা কিন্তু প্রশ্ন তুলছেন, “আর কত বার আমাদের ইউসি দিতে হবে?” আর খাবার না পেয়ে ফের ভিখারির জীবনে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন আনারবানুরাও। |
(সহ প্রতিবেদন: দয়াল সেনগুপ্ত) |