সিবিআই-কে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার বিষয়ে মনমোহন-সরকারের মনোবাঞ্ছা নিয়ে আগেই প্রশ্ন তুলেছে বিজেপি। আজ ইশরাত জহান হত্যা মামলায় চার্জশিট পেশের পরে সিবিআই-এর ভূমিকা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলছে তারা। এ দিনই সিবিআই-কে স্বাধীনতা দেওয়ার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা পেশ করেছে কেন্দ্র। তাতে স্পষ্ট, সিবিআই-এর বেশ কিছু দাবি সরকার মানছে না এবং আইন মন্ত্রকের প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্তও করা হচ্ছে না তদন্ত সংস্থাটিকে। ফলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো নিয়ে চাপানউতোর এতে থামছে না।
সিবিআই-কে ‘রাজনৈতিক প্রভুদের খাঁচার তোতা’ করে রাখার জন্য দু’মাস আগে সুপ্রিম কোর্টের ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হয়েছিল কেন্দ্রকে। আদালতের নির্দেশ ছিল, সিবিআই-কে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার জন্য সরকার কী করছে, তা হলফনামা দিয়ে জানাতে হবে। শীর্ষ আদালতে ৪১ পৃষ্ঠার হলফনামা দিয়ে কেন্দ্র জানিয়েছে, সিবিআই-কে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত করতে মূলত ৩টি পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
এক, সিবিআই-প্রধান নিয়োগের ক্ষমতা এখন সরকারের হাতে। একটি কলেজিয়ামের হাতে সেই ক্ষমতা তুলে দেওয়া হবে। তাতে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী দলনেতা ও প্রধান বিচারপতি। ওই কলেজিয়ামই রাষ্ট্রপতির কাছে নাম সুপারিশ করবে সিবিআই-প্রধান নিয়োগের জন্য। দুর্নীতি দমন এবং অপরাধের তদন্তে অভিজ্ঞতা রয়েছে, এমন আইপিএস অফিসারকেই এই পদে নিয়োগ করা হবে। ওই পদে তাঁর মেয়াদ হবে অন্তত দু’বছর। একমাত্র কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশনের সুপারিশেই রাষ্ট্রপতি সিবিআই-প্রধানকে পদ থেকে সরাতে পারবেন।
দুই, সিবিআই-এর তদন্তে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য একটি দায়বদ্ধতা কমিশন গড়া হবে। তাতে থাকবেন অবসরপ্রাপ্ত তিন জন বিচারপতি।
তিন, কোনও সরকারি আমলার বিরুদ্ধে মামলা করার অনুমতি চেয়ে তিন মাসে তা না পেলে সিবিআই নিজেই মামলা করতে পারবে।
এই তিন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলেও অবশ্য আইন মন্ত্রকের প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত হবে না সিবিআই। কয়লাখনি বণ্টনে দুর্নীতির তদন্ত রিপোর্ট আদালতে পেশ করার আগেই সিবিআই-কে তা কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের কর্তাদের দেখাতে হয়েছিল। তাঁদের পরামর্শে রিপোর্টে বদলও করা হয়। মূল রিপোর্টের সঙ্গে বদলানো রিপোর্ট মিলিয়ে ক্ষুব্ধ আদালত বলে, রিপোর্টের মূল সুরই বদলে দেওয়া হয়েছে। এর জেরে শেষ পর্যন্ত আইনমন্ত্রীর গদি ছাড়তে হয় অশ্বিনী কুমারকে। আইন মন্ত্রকের এই খবরদারি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যই সিবিআই-এর দাবি ছিল, তাদের নিজেদের মতো করে আইনজীবী নিয়োগ করতে দেওয়া হোক। কিন্তু সিবিআই-কে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। সরকারি আইনজীবীদের মাধ্যমেই মামলা চালাতে হবে তাদের। তবে সিবিআই-প্রধানকে আরও বেশি আর্থিক ক্ষমতা দেওয়া হবে।
তবে সুপ্রিম কোর্টকে সরকার জানিয়েছে, আইন মন্ত্রকের ক্ষমতা অনেকটাই খর্ব করা হচ্ছে। সিবিআই-এর দাবি ছিল, অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করার দায়িত্বপ্রাপ্ত শাখা আইন মন্ত্রকের অধীন। ফলে তারা যে কোনও তদন্ত রিপোর্ট খারিজ করে দিতে পারে। ওই শাখার প্রধানকেও নিয়োগ করে আইন মন্ত্রক। সরকার হলফনামায় জানিয়েছে, আইন মন্ত্রকের হাতে আর ওই নিয়োগের ক্ষমতা থাকবে না।
বিজেপি নেতা অরুণ জেটলি আগেই অভিযোগ তুলেছেন, সরকারের এই সিবিআই-কে মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনা আসলে পুরোটাই ভড়ং। মনমোহন সরকার আসলে ঘুরপথে সিবিআই-এর উপর প্রভাব খাটাতে চাইছে। ইশরাত জহান হত্যা মামলার চার্জশিটে সিবিআই ভুয়ো সংঘর্ষে ইশরাতকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করায়, এর মধ্যেও রাজনীতির গন্ধ পাচ্ছে বিজেপি। একই ভাবে রেলে দুর্নীতির মামলায় যে ভাবে পবন বনশলকে ছাড় দেওয়া হয়েছে, তার পিছনেও রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর অভিযোগ তুলছে বিজেপি। তাদের অভিযোগ, এখানেও প্রধানমন্ত্রী দফতরকে আড়াল করতেই বনশলকে চার্জশিট থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্র হলফনামায় জানিয়েছে, সরকার কোনও ভাবেই সিবিআই তদন্তে বা মামলায় প্রভাব খাটাবে না। বিরোধীরা শুধু এই প্রতিশ্রুতিতেই আশ্বস্ত হতে পারছে না। ১০ জুলাই সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার চূড়ান্ত শুনানি হবে। সেখানে সুপ্রিম কোর্ট সরকারের হলফনামায় সন্তুষ্ট হয় কি না, সেটাই দেখার।
আদালতেই অবশ্য সরকারের সমস্যা থামছে না। সিবিআই গঠন করা হয়েছিল দিল্লি পুলিশ এস্টাব্লিশমেন্ট আইনে। সিবিআই-কে স্বাধীনতা দিতে হলে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, সংসদে আইন সংশোধন করতে হবে সরকারকে। তা করা হবে বলে হলফনামায় জানিয়েছে কেন্দ্র। কিন্তু বিরোধীরা যে ভাবে বেঁকে বসেছে, তাতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ কার্যকর করতে গিয়েও কতটা বেগ পেতে হবে, সেটাই ভাবাচ্ছে মনমোহন সরকারকে।
|