|
|
|
|
এসপি-র গতিবিধি কে জানাল মাওবাদীদের, খুঁজছে পুলিশ |
অপূর্ব চট্টোপাধ্যায় • কাঠিকুণ্ড
সুরবেক বিশ্বাস • কলকাতা |
সফর গোপন রাখতে গাড়ির মাথায় লাল আলো ছিল না। নম্বর প্লেটও রাখা হয়নি গাড়িতে। তা সত্ত্বেও পাকুড়ের পুলিশ সুপার অমরজিৎ বলিহার যে ওই সাদা এসইউভি-তেই আছেন, সে বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিল মাওবাদীরা।
তদন্তকারীদের সন্দেহ, দুমকায় ডিআইজি সার্কিট হাউস থেকে এসপি কোন গাড়িতে কখন বেরোচ্ছেন, কোন রাস্তা ধরে পাকুড় ফিরছেন, সব কিছুই নখদর্পণে ছিল মাওবাদীদের। সে জন্য বোল্ডার ফেলে কিংবা অন্য গাড়ি দিয়ে রাস্তা আটকানোর মতো চালু পদ্ধতি তারা ব্যবহার করেনি। সরাসরি গুলি করে এসপি-র গাড়ির সামনের চাকা ফাঁসিয়ে দিয়েছিল।
লাল আলো ও নম্বর প্লেট না-লাগিয়ে তাঁর দুমকায় যাতায়াতের বিষয়টি যথাসম্ভব গোপন রাখতে চেয়েছিলেন অমরজিৎ। এমনকী, ডিআইজি-র সঙ্গে এসপি যে বৈঠক করতে যাচ্ছেন, সেটা জানতেন পাকুড় জেলা পুলিশের মাত্র কয়েক জন কর্তা। তার পরেও এসপি কোন রাস্তায় ফিরছেন, কোন গাড়িতে তিনি আছেন, সেটা মাওবাদীরা জেনে যাওয়ায় উদ্বেগ বেড়েছে পুলিশের। তাই, হামলাকারীদের সন্ধান করার পাশাপাশি মাওবাদীদের ওই চরেদেরও খোঁজ করছেন পুলিশ ও গোয়েন্দারা। |
 |
কাচে বুলেটের ক্ষত। নিহত এসপির গাড়ি ঘিরে তদন্ত। বুধবার। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম |
মঙ্গলবার সকাল আটটা নাগাদ পাকুড় থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে দুমকার উদ্দেশে রওনা হন অমরজিৎ বলিহার। তিনি পাকুড়-দুমকা রাস্তা ধরেই দুমকা পৌঁছন এবং বৈঠক শেষে দুপুর দু’টো নাগাদ দুমকা থেকে রওনা হয়ে ফিরছিলেনও একই রাস্তা ধরে। পাকুড় থেকে দুমকা যাওয়ার ওটাই একমাত্র পথ। দুমকা যাওয়ার সময়ে অমরাপাড়া থানার একটি ‘এসকর্ট’ গাড়ি এসপি-কে নিজেদের এলাকার সীমানা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিল। তদন্তকারীদের সন্দেহ, অমরজিতের উপর পুরোদস্তুর হামলা চালাতে তৈরি মাওবাদীরা পুলিশের কনভয় দেখেও লাল আলো কিংবা নাম্বার প্লেট না-থাকায় প্রথমটায় দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। পরে, দুমকা থেকেই তারা নিশ্চিত হয়, নম্বর প্লেটহীন সাদা ওই এসইউভি-তে তাদের টার্গেট অমরজিৎ বলিহার-ই রয়েছেন।
অন্য এক গোয়েন্দা-অফিসার বলেন, “সাধারণত মাওবাদীরা সেই সময়েই হামলা চালায়, যখন ‘টার্গেট’ গন্তব্য থেকে ফিরছে। প্রথমত, গন্তব্যে যাওয়ার সময়ে পুলিশ যতটা সতর্ক থাকে, ফেরার সময়ে ক্লান্তি ও নিশ্চিন্ত মনোভাব এসে যায় তাঁদের মধ্যে। দ্বিতীয়ত, বিকেলের দিকে হামলা চালালে জঙ্গলপথে মাওবাদীদের পক্ষে পালানো সহজ হয়। তা ছাড়া, পাকুড়-দুমকা সড়কে সকাল থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত যতটা যানবাহন থাকে, তার পর আর ততটা থাকে না।”
তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, মাওবাদীদের গুলিবৃষ্টির মুখে বাকি পুলিশেরা গোড়াতেই হার মেনে গেলেও একমাত্র অমরজিৎ কিছুটা লড়ার চেষ্টা করেছিলেন। সে জন্য তাঁর রক্তাক্ত দেহটি গাড়ির বাইরে একটি নির্মীয়মাণ সেতুর নীচে পাওয়া যায়। এসপি গাড়ির বাইরে বেরিয়ে সম্ভবত পাল্টা গুলিও চালান বলে তদন্তকারীরা মনে করছেন। তার আগে মোবাইলে ফোন করে সাহায্য চান অমরাপাড়া থানার ওসি রণজিৎ মিন্জের কাছে। ওসি যখন এসপি-র কাছ থেকে ফোন পান, তখন তাঁর ঘড়িতে বেলা ২টো ৩২। ওই রণজিৎ মিন্জই সকালে কিছুটা পথ ‘এসকর্ট’ করেছিলেন এসপি-কে। অমরাপাড়ার ওসি-কে ফোনে এসপি ফোনে জানান, তিনি মাওবাদী হামলার মুখে পড়েছেন এবং অবিলম্বে তাঁর সাহায্য প্রয়োজন। অমরাপাড়ার ওসি সেই সময়ে কাঠিকুণ্ডের ওই ঘটনাস্থল থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে। তিনি যখন বাহিনী নিয়ে গিয়ে পৌঁছন, সব শেষ।
প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, পুরুষ ও মহিলা মিলিয়ে প্রায় ৫০ জন মাওবাদী টানা ১৫ মিনিট ধরে অন্তত ২০০ রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল। যে-রাস্তা দিয়ে বলিহারের গাড়ি দুমকা থেকে পাকুড় যাচ্ছিল, সেই রাস্তার দু’দিকেই ‘পজিশন’ নিয়ে অপেক্ষা করছিল মাওবাদীরা। গুলির খোল দেখে তদন্তকারীদের ধারণা, একে-৪৭ কিংবা ইনস্যাস নয়, সাধারণ এসএলআর থেকেই নাগাড়ে গুলি ছুঁড়ে গিয়েছিল মাওবাদীরা।
গোয়েন্দারা প্রাথমিক ভাবে জেনেছেন, মাওবাদীদের দুমকা-পাকুড়ের এরিয়া কমান্ডার প্রবীরদা ওরফে হরিচরণ টুডু এসপি-র উপরে ওই হামলার পরিকল্পনা করেন ও নেতৃত্ব
দেন। জানুয়ারি মাসে পুলিশের হাতে ধরা পড়া আশুতোষজি ওরফে রামজি ওরফে ছোটুর স্কোয়াডই হামলার অগ্রভাগে ছিল। কিন্তু পুলিশ তখন জেনেছিল, আশুতোষজির স্কোয়াডের সদস্যসংখ্যা ১৭-১৮। তা হলে ৫০ জন মাওবাদী এল কোথা থেকে?
ঝাড়খণ্ড পুলিশের এক কর্তার কথায়, “ঝাড়খণ্ডের অন্যান্য এলাকা এবং পার্শ্ববর্তী রাজ্য বিহার, এমনকী পশ্চিমবঙ্গ থেকেও মাওবাদী অ্যাকশন স্কোয়াডের সদস্যদের ওই হামলার জন্য জড়ো করা হয়। কাজেই, এটা এক-আধ দিনে হঠাৎ তৈরি হওয়া পরিকল্পনা নয়।”
বুধবার সকালে কাঠিকুণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান রাজ্যপালের পরামর্শদাতা আনন্দ শঙ্কর, ডিজি রাজীব কুমার ও স্বরাষ্ট্র সচিব এন এন পাণ্ডে। ঝাড়খণ্ডে এখন রাষ্ট্রপতি শাসন জারি রয়েছে। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের দায়িত্বে থাকা আনন্দ শঙ্কর বলেন, “মাওবাদীদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তারক্ষীরা কঠোর ব্যবস্থা নিতে অভিযান শুরু করেছেন। যদি প্রয়োজন হয়, কেন্দ্রের সাহায্য নেওয়া হবে।” ডিজি রাজীব কুমারের কথায়, “মাওবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযান বন্ধ করার প্রশ্ন নেই। একেবারে শেষ দেখে ছাড়া হবে।”এ দিন পাকুড়ের নতুন এসপি করা হয়েছে ২০১০ ব্যাচের আইপিএস অফিসার ওয়াই এইচ রমেশকে।
রমেশের পূর্বসূরি অমরজিৎকে কাঠিকুণ্ডের যেখানে হত্যা করা হয়, তার আশপাশে কোনও জনবসতি নেই। এক দিকে জামনি এবং অন্যদিকে আমতলা গ্রাম। ঘটনাস্থল থেকে দু’টি গ্রামেরই দূরত্ব ২০০ মিটার। জামনি গ্রামের গা ঘেঁষেই রয়েছে ঝাড়খণ্ড সশস্ত্র পুলিশের ক্যাম্প। যেখানে সারাক্ষণ মোতায়েন থাকে ২৫ জন পুলিশকর্মী। ২০১২-র নভেম্বরে ওই এলাকার কাছাকাছি সাহেবগঞ্জ-গোবিন্দপুর রাস্তা সংস্কারে দায়িত্বপ্রাপ্ত একটি সংস্থার আটটি গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল মাওবাদীরা। তার পর থেকেই ওই পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়। ক্যাম্পের এক জন পুলিশের কথায়, “দশ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে টানা গুলির আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলাম। কাঠিকুণ্ড থানায় খবরও দেওয়া হয়। থানা থেকে পুলিশ যাওয়ার পর ঘটনাস্থলে পৌঁছয় ক্যাম্পের পুলিশ।” কিন্তু গুলির শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যাননি কেন? তা হলে হয়তো এসপি ও তাঁর দেহরক্ষীদের ওই অসম লড়াইয়ের মুখে পড়তে হত না! ওই পুলিশের অকপট স্বীকারোক্তি, “আমরা যেতে সাহস পাইনি।” আসলে সেই সময়ে সাহসের প্রশ্নে ক্যাম্পের ওই পুলিশদের সঙ্গে আমতলা গ্রামের বাসিন্দাদের তফাত ছিল না। গ্রামের মানুষও একটানা গুলির শব্দ শুনতে পান। তাঁদের এক জন ঢ্যানা মুর্মুর কথায়, “অনেকেই তখন মাঠে চাষের কাজ করছিলেন। গুলির শব্দে সকলেই বাড়িতে ঢুকে পড়ি। কিছু ক্ষণ পরে গুলির আওয়াজ থামে।”
পুলিশ জানতে পেরেছে, এসপি এবং নিহত ও আহত অন্য পুলিশদের কাছ থেকে অস্ত্র ও গুলি লুঠ করে মাওবাদীরা। এর পর দুমকা-পাকুড় রাস্তা লাগোয়া জঙ্গলে ঢুকে পড়ে। সাহেবগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ শাওয়ালা পাহাড়ের পথ দিয়ে হেঁটে চলে যায়।
|
পুরনো খবর: মাওবাদী হানা এ বার রাজ্যের দোরে, এসপি-সহ হত ৭ পুলিশ |
|
|
 |
|
|