|
|
|
|
ইশরাত খুন ঠান্ডা মাথায়, চার্জশিটে অস্বস্তিতে বিজেপি |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
একটা পায়ে জুতো। আর একটা পা খালি। কমলা রঙের সালোয়ার-কামিজ পরা মেয়েটার লাশ পড়ে রয়েছে। তার ডান দিকে পড়ে রয়েছে আরও তিন জন। পুরুষ।
২০০৪ সালের ১৫ জুন টিভির পর্দায় ছবিটা সারা দিন ধরে দেখেছিল গোটা দেশ। তখনই জানা গিয়েছিল ১৯ বছরের কলেজ পড়ুয়া মেয়েটির নাম ইশরাত জহান। গুজরাত পুলিশ দাবি করেছিল, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিল ইশরাত আর তার বন্ধুরা। ওরা লস্কর জঙ্গি। আমদাবাদের রাস্তায় পুলিশের সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে মারা গিয়েছে চার জন।
নয় বছর পরে আজ সিবিআই গুজরাতের অতিরিক্ত মুখ্য ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে ইশরাত জহান মামলার চার্জশিট পেশ করে বলল, ঠান্ডা মাথায় ওই চার তরুণ-তরুণীকে হত্যা করেছিল গুজরাত পুলিশ। তার পর ঘটনাটাকে সংঘর্ষের চেহারা দিতে নিহতদের হাতে গুঁজে দিয়েছিল একে-৪৭ এবং আরও কিছু অস্ত্রশস্ত্র। অর্থাৎ শেখ সোহরাবুদ্দিনের পর এ বার আরও একটা ভুয়ো সংঘর্ষের মামলায় জড়িয়ে গেল মোদীর পুলিশের নাম।
মোদীর পুলিশ, মোদী নন সরাসরি। নরেন্দ্র মোদী বা তাঁর ঘনিষ্ঠ, সোহরাবুদ্দিন মামলায় অভিযুক্ত প্রাক্তন পুলিশমন্ত্রী অমিত শাহের নাম চার্জশিটে নেই। রয়েছে আইপিএস জি এল সিঙ্ঘল, আইপিএস ডি জি বানজারা, এডিজি পি পি পাণ্ডে-সহ মোট সাত জন পুলিশ অফিসারের নাম। তার মধ্যে বানজারা আগেই সোহরাবুদ্দিন মামলায় অভিযুক্ত হয়ে সাসপেন্ড হয়েছিলেন। পাণ্ডে এখন ফেরার।
কারও কারও দাবি, কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে সম্ভবত সিবিআই-কে মোদীর নাম না-রাখার পরামর্শই দেওয়া হয়েছে। কারণ, মোদীর নাম রাখামাত্র বিজেপি বলতে শুরু করত, কংগ্রেস রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সিবিআই-কে ব্যবহার করছে। বিজেপি-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলই কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ বিভিন্ন সময় তুলেছে। প্রাক-নির্বাচনী বছরে মোদী তথা বিজেপি-র হাতে নতুন করে প্রচারের অস্ত্র তুলে না-দিতেই এই কৌশল বলে মনে করা হচ্ছে। কংগ্রেস সূত্রে দাবি, সিবিআইয়ের চার্জশিটে মোদীর নাম না-রেখেও তাঁর সরকারের প্রতি আঙুল তোলা গিয়েছে। তাতে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না বলে আশা করছেন তাঁরা। এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক মধুসূদন মিস্ত্রি আজ বলেন, “সত্যিটা ঠিকই বেরোয়। মোদীর আসল চেহারাটা খুব শিগগিরি সামনে আসবে।” মণীশ তিওয়ারির কটাক্ষ, সিবিআই নিয়ে বিজেপি দ্বিমুখী আচরণ করে। “হরেন পাণ্ড্য মামলায় যখন সিবিআইয়ের চার্জশিট মোদীর পক্ষে গেল, তখন তো কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। এখন যেই বিষয়টা ওঁদের বিপক্ষে গেল, ওঁরা বলছেন, সিবিআই নাকি কংগ্রেস ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন!” |
ডি জি বানজারা |
জি এল সিঙ্ঘল |
তরুণ ভানোট |
এন কে আমিন |
|
ইশরাত মামলার চার্জশিট বিজেপি তথা মোদীকে কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলেছে বটেই। ঘটনাচক্রে আগামিকালই দিল্লি আসছেন মোদী। আসন্ন লোকসভা ভোটের প্রচার নিয়ে দলীয় বৈঠক করবেন। তার আগের দিনই ইশরাত মামলার চার্জশিট পেশ হল। পাশাপাশি, সিবিআই-কে স্বাধীনতা দেওয়া নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে হলফনামাও জমা দিল কেন্দ্র। কিন্তু কেন্দ্র যে আসলে সিবিআই-কে নিজের মতো করেই ব্যবহার করতে চায়, ইশরাত মামলা তার আরও একটা প্রমাণ বলে আজ সুর চড়িয়েছে বিজেপি। সেই সঙ্গে সিবিআইয়ের
চার্জশিট নিয়ে তাদের সমালোচনার কেন্দ্রে রয়েছে সন্ত্রাসের প্রসঙ্গ।
সিবিআই চার্জশিটে বলেছে ইশরাতরা যে মোদীকে খুনের ছক করছিল, সে প্রমাণ নেই। আইবি-র যে সতর্কবার্তার ভিত্তিতে গুজরাত পুলিশ ইশরাতদের পাকড়াও করে, তা ভুয়ো। সিবিআইয়ের এই সিদ্ধান্তের নিরিখেই ইশরাতের পরিবারের দাবি, তাঁদের মেয়ে নির্দোষ প্রমাণিত হল। কিন্তু ইশরাত এবং তার তিন সঙ্গীর সঙ্গে লস্কর জঙ্গিদের সম্পর্ক ছিল কি না, তাদের মধ্যে দু’জন পাকিস্তান থেকে এসেছিল কি না, তা চার্জশিটে নেই। এই ফাঁক নিয়েই প্রশ্ন তুলছে বিজেপি।
কিন্তু সিবিআইয়ের বক্তব্য, ইশরাত মামলার তদন্তভার তারা হাতে নিয়েছে গুজরাত হাইকোর্টের নির্দেশে। হাইকোর্ট বলেছিল, ইশরাতদের মৃত্যু ভুয়ো সংঘর্ষে হয়েছে কি না, খতিয়ে দেখতে। ইশরাতদের প্রকৃত পরিচয় খোঁজা তাদের দায়িত্ব নয়। বিজেপি মুখপাত্র নির্মালা সীতারামন যদিও অভিযোগ করেন, এ ভাবে লস্করের ভূমিকাটাকেই লঘু করে দেখা হচ্ছে। সন্ত্রাস নিয়ে রাজনীতি করা কংগ্রেসের উচিত হচ্ছে না। আরও একটা প্রশ্ন তুলছে বিজেপি। সেটা হল, আইবি-র ভূমিকা। সেই নিরিখে কেন্দ্রের ভূমিকাও তার মধ্যে ঢুকে পড়ছে।
সিবিআইয়ের চার্জশিটে স্পষ্ট বলা হয়েছে, মোদীকে খুন করার ব্যাপারে আইবি-র সতর্কবার্তা ভুয়ো ছিল এবং ইশরাত হত্যা গুজরাত পুলিশ এবং গুজরাতে আইবি-র সাবসিডিয়ারি ইনটেলিজেন্স ব্যুরো-র যৌথ অপারেশন ছিল। আইবি-র তৎকালীন স্টেশন ডিরেক্টর রাজেন্দ্র বর্মা-সহ চার আইবি অফিসারের ভূমিকা নিয়ে তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছে সিবিআই। প্রয়োজনে তারা অল্প কিছু দিনের মধ্যেই একটি অতিরিক্ত চার্জশিট দাখিল করবে বলেও জানিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, আইবি তো কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকেরই অধীন। ২০০৪ সালে মন্ত্রক তার হলফনামায় ইশরাতদের লস্কর জঙ্গি বলেই মেনেছিল। তা হলে?
সিবিআইয়ের চার্জশিট বলছে, ২০০৮-এর এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে দফায় দফায় ইশরাতদের চার জনকে অপহরণ করে আলাদা আলাদা জায়গায় রাখে গুজরাত পুলিশ। প্রথমে তোলা হয় জিশান আলিকে, তার পর আমজাদ আলি রানা, শেষে ইশরাত এবং জাভেদ শেখ। ১৫ জুন গাড়ি করে এক জায়গায় এনে তাদের গুলি করে মারা হয়। অপহরণ থেকে শুরু করে মৃতদেহের হাতে গুঁজে দেওয়ার মতো অস্ত্র জোগাড় করা, সবেতেই আইবি অফিসারদের ভূমিকা ছিল বলে সিবিআইয়ের ইঙ্গিত। গুজরাতেরই ২০ জন পুলিশ অফিসারের সাক্ষ্য এই তদন্তে প্রধান ভূমিকা নিয়েছে। সূত্রের খবর, আইবি অফিসার রাজেন্দ্র বর্মার নামও চার্জশিটে রাখতে চায় সিবিআই। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অনুমতি মেলেনি। কেন? তা নিয়েও ধন্দ। তবে কংগ্রেসের একাংশ প্রশ্নটাও মোদীর দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বলছে, গুজরাত সরকারই বর্মাকে আড়াল করতে চেয়েছে। তবে শোনা যাচ্ছে, এ মাসের ৩১শেই অবসর নেবেন রাজেন্দ্র। তখন সিবিআই তাঁর বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করার কথা ভাববে।
ইশরাতদের মৃত্যু যে ভুয়ো সংঘর্ষে হয়েছিল, তা প্রথম বলেন আমদাবাদ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এস পি তামাং। সেটা ২০০৯-র কথা। তখন অন্য একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গঠিত এক বিশেষ তদন্তকারী দলকে (এসআইটি) ইশরাত মামলাটির দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করে গুজরাত হাইকোর্ট। কিন্তু এসআইটি রাজি হয়নি। তখন গুজরাত হাইকোর্ট নিজে একটি এসআইটি গড়ে দেয়। সেই এসআইটি-র স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় ২০১১ সালে হাইকোর্টের নির্দেশেই মামলা যায় সিবিআইয়ের হাতে।
ইশরাতের মা-বোন-কাকা বলছেন, সিবিআইয়ের চার্জশিটে তাঁরা খুশি। তবে প্রধান দেশের দুই দল, কংগ্রেস ও বিজেপি, কেউই পুরো স্বস্তিতে নেই।
|
ছবি: পিটিআই |
পুরনো খবর: ইশরাত মামলায় সিবিআই-আইবি সংঘাত তুঙ্গে |
|
|
|
|
|