এ যেন গরিব বাড়িতে কুটুম এসে বাড়তি দু’দশ দিন রয়ে গিয়েছে। দু’বেলা ভালমন্দ জোটাতে গেরস্তের প্রাণান্ত।
২ জুলাই প্রথম দফায় নয় জেলায় পঞ্চায়েত নির্বাচন হবে ধরে নিয়ে যে প্রার্থীরা ঝুলি ঝেড়ে প্রচারে নেমেছিলেন, তাঁদের অনেকেরই সম্বল ইতিমধ্যে তলানিতে ঠেকেছে। অথচ রাজ্য সরকার আর নির্বাচন কমিশনের দড়ি টানাটানিতে ভোট পিছিয়ে গিয়েছে কোথাও ন’দিন, কোথাও বা ১৭ দিন। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরের ভোট পিছিয়েছে ন’দিন। ১৩ দিন পিছিয়ে গিয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর, হুগলি ও বর্ধমানের ভোট। হাওড়া ও দুই ২৪ পরগনায় ভোট হচ্ছে ১৭ দিন পরে। অতগুলো দিন প্রচারের ধুনি জ্বালিয়ে রাখতে হবে। বাড়তি বোঝা টানতে অতএব কেউ চড়া সুদে ঋণ নিচ্ছেন, কেউ হাত দিয়েছেন ছেলের জন্য জমানো টাকায়, কারও মেয়ের বিয়ে শিকেয় উঠেছে।
ভোটে লড়ার খরচ কি কম? প্রচারের জন্য দেওয়াল লিখন, পোস্টার, ফ্ল্যাগ-ফেস্টুন তো আছেই। সব সময়ের কর্মীদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও করতে হয়। মিছিল বা পথসভা হলে জোগাতে হয় টিফিন থেকে শুরু করে মোটরবাইকের তেলের দাম। পঞ্চায়েত নির্বাচনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দলগুলি দরাজহস্ত হয়ে খরচ করে না। স্বচ্ছল কর্মী-সমর্থকদের কিছু টাকা আসে। বাকিটা যায় প্রার্থীর নিজের পকেট থেকেই। সেই সব পকেটেই টান পড়েছে।
টান বলে টান?
উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল প্রার্থী ধ্যানেশনারায়ণ গুহ থেকে শুরু করে বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সৌমেন দত্ত, সকলেই টাকার জন্য হাপিত্যেশ করছেন। সন্দেশখালির দেড়মজুর পঞ্চায়েতের এক কংগ্রেস প্রার্থীর মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছিল ৪ জুলাই। ভোট পিছোতেই তা এক ধাক্কায় দু’মাস পিছিয়ে গিয়েছে। “নাম লিখবেন না দাদা! মেয়ের বিয়ের টাকা ভোটে লাগিয়েছি জানলে নাক কাটা যাবে” হাত জোড় করে অনুরোধ করেন তিনি। বাদুড়িয়ার কাঠিয়াহাট পঞ্চায়েতের এক তৃণমূল প্রার্থী আবার ৫০ হাজার টাকা জোগাড় করেছেন এক বিঘা জমি বন্ধক রেখে।
মঙ্গলবার হুগলির চণ্ডীতলা ২ ব্লকে তৃণমূল অফিসে কার্যত মাথায় হাত দিয়েই বসেছিলেন পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী বিকাশ ঘোষ। ব্যাজার মুখেই জানান, “২ জুলাই ভোট হবে ধরে নিয়ে প্রায় সব টাকা খরচা করে ফেলেছি। এখন তো হাত একেবারেই ফাঁকা। সংসার খরচের টাকাও ভোটে চলে যাচ্ছে।” ওই পঞ্চায়েত সমিতিরই তৃণমূল প্রার্থী সুমিতা বোধকও চিন্তিত, “এ বার না ছেলের জন্য জমানো টাকায় হাত পড়ে!” কেব্ল টিভি সংস্থায় কাজ করেন মেদিনীপুর সদর ব্লকের গোলাপি গ্রাম পঞ্চায়েতের বিজেপি প্রার্থী রমেশ রায়। তাঁর কথায়, “যা বাজেট ধরা ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি খরচ হয়ে গিয়েছে। এখনই প্রায় হাজার দশেক টাকা ধার করতে হয়েছে। এর পরে কী করব?”
এ বার নির্বাচনে ৫০ শতাংশ প্রার্থীই মহিলা। এর মধ্যে তফসিলি জাতি ও উপজাতির প্রান্তিক মহিলারাও রয়েছেন। শালবনির সিজুয়া এলাকার কংগ্রেসের প্রার্থী রিনা সোরেন বলেই ফেলেন, “শ্বশুরবাড়িতে থাকা-খাওয়ার সমস্যা নেই। কিন্তু এখন কী গেরো! ধার দেনা করে প্রচারের খরচ জোগাড় করছি।” একই কথা শালবনি পঞ্চায়েতে সমিতির কংগ্রেস প্রার্থী নিবেদিতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। পূর্ব মেদিনীপুরে ডেবরার ভগবানপুরে পঞ্চায়েতের প্রার্থী সবিতা সোরেনের আক্ষেপ, “চেয়ে-চিন্তে আর কত চালানো যায়!”
মুর্শিদাবাদের বহরমপুর ৪০ নম্বর জেলা পরিষদ আসনের তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী মাসতুরা খাতুন বা লালগোলার বাহদুরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের মল্লিকপুর গ্রাম সংসদের প্রার্থী কংগ্রেসের হাসিনা বিবিরও একই দশা। হাসিনা বলেন, “ভোটের পরিবর্তিত দিন ২২ জুলাই রমজান মাসের মধ্যে। ফলে সারা দিন রোজার উপবাসে থাকা দলীয় কর্মী যাঁরা ভোটের প্রচারে থাকবেন তাঁদের ইফতারির ব্যবস্থা করতে হবে। স্বাভবিক নিয়মেই খরচ বাড়বে।” শুধু প্রার্থীদের নয়, জেলা প্রশাসনের খরচও বাড়ছে। প্রথমে ঠিক ছিল, ২ জুলাই দক্ষিণবঙ্গের নয় জেলায় নির্বাচন। ১৩ জুলাই গণনা। সেই মতো পশ্চিম মেদিনীপুরে গাড়ি থেকে শুরু করে ভোটকর্মীদের সরঞ্জাম ভাড়া করা হয়েছিল। চুক্তি হয়েছিল ডেকরেটারের সঙ্গে। তার জন্য এখন ডেকরেটরেরা বেশি ভাড়া চাইছেন। প্রশাসন সূত্রের খবর, ব্লক পিছু দশটি গ্রাম পঞ্চায়েত ধরে আনুমানিক গড় খরচ ধরা হয়েছিল প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা। ভোট পিছোনোয় তা গড়ে প্রায় লক্ষাধিক ছাড়িয়ে যেতে পারে। |