নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
রমজান মাসে নির্জলা উপবাসে শারীরিক কষ্ট রয়েছে ঠিকই। কিন্তু তাই বলে ভোট দেওয়ার মতো নাগরিক কর্তব্য পালন বন্ধ রাখার পক্ষপাতী নন সংখ্যালঘু নেতাদের অনেকেই। তাঁদের মতে, রোজা চলাকালীন কাজকর্ম বন্ধ রাখার কোনও বিধান ধর্মীয় অনুশাসনে নেই।
রাজ্যে রমজানের মধ্যে পঞ্চায়েত ভোট না-করার আবেদন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল একাধিক রাজনৈতিক দল এবং সংখ্যালঘু সংগঠন। কিন্তু আদালত সংবিধানের নির্দেশকে মান্য করে ভোটের সূচি অপরিবর্তিত রেখেছে। আর শীর্ষ আদালতের নির্দেশ শিরোধার্য করে সংখ্যালঘু মানুষকে ভোট দেওয়ার আর্জি জানিয়েছেন দিল্লির জামা মসজিদের শাহি ইমাম সৈয়দ আহমেদ বুখারি থেকে হুগলির ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকী সকলেই। শাহি ইমাম বুখারির মতে, “রমজান মাসে নাগরিক কর্তব্য পালনে কোনও ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা নেই। কিন্তু ১৭-১৮ ঘণ্টা নির্জলা উপবাসের সময় বাইরে কাজ করাটা সমস্যার। তা-ও আবার গরমের মধ্যে। তবে আদালত হুকুম দিলে তো সেটুকু অসুবিধা মেনে নিতেই হবে।”
গত শুক্রবারই সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকারের আইনজীবী গোপাল সুব্রহ্মণ্যম রমজানের মধ্যে ভোট না-রাখার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু পঞ্চায়েতের মেয়াদ যে হেতু ইতিমধ্যেই ফুরোতে শুরু করেছে, তাই শীর্ষ আদালত ভোটের তারিখ নতুন করে পিছোতে চায়নি। এ দিনও যখন প্রসঙ্গটি ওঠে, বিচারপতিরা স্পষ্ট বলেন, তাঁরা ধর্মীয় ভাবাবেগের চেয়ে সংবিধানকে বেশি মান্যতা দিচ্ছেন। পঞ্চায়েত নির্বাচন দেরির জন্য রাজ্য সরকারের ‘গড়িমসি’কেই দায়ী করেন তাঁরা।
বর্ষা ও রমজানে ভোট হওয়ার জন্য রাজ্য সরকারকে দায়ী করেছেন ত্বহা সিদ্দিকীও। তাঁর বক্তব্য, “সংখ্যালঘুদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে! তবে সকলকেই ভোট দেওয়ার আবেদন করছি।”
একই সুরে ইউডিএফ নেতা সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীও বলেছেন, “রাজ্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জেদাজেদির কারণে রমজান মাসে এই ভোট হচ্ছে। তবে ভোট বয়কটের পক্ষেও নই আমরা।” মুসলিমদের ধর্মাচরণের অসুবিধার কথা উল্লেখ করেই সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছিল কংগ্রেসের সংখ্যালঘু শাখা। প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান বলেন, “রাজ্য সরকার হাইকোর্টের রায় মেনে নিলেই রমজান মাসে ভোট গড়াত না!”
রমজান মাসে ভোট হলে কী ধরনের অসুবিধা হয়ে থাকে?
মান্নানের বক্তব্য, “মাইকে প্রচার হলে সেই আওয়াজে নমাজে বিঘ্ন ঘটে। তা ছাড়া, ভোটের প্রচারে দীর্ঘ ক্ষণ বক্তৃতা করতে গিয়ে গলা শুকিয়ে গেলেও জল পর্যন্ত খাওয়া যাবে না।”
প্রাক্তন বিধায়কের আরও যুক্তি, “রোজার সময় কাউকে আঘাত দেওয়া, কটু বা মিথ্যা কথা বলা নিষেধ। সেই জন্য প্রচারে গিয়ে অন্য দল বা কোনও নেতার বিরুদ্ধে কোনও আক্রমণাত্মক কথা বলা যাবে না!” সিদ্দিকুল্লা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, উপবাসে থেকে বয়স্ক ও অসুস্থদের দীর্ঘক্ষণ ভোটের লাইনে দাঁড়াতে অসুবিধা হবে।
তাঁর কথায়, “উপবাস করে বাড়িতে থাকা যায়। বাইরে বেরোতে হলেও হালকা কাজ রাখেন রোজাদাররা। ভোটের দু’দিন আগে থেকে ভোট-কর্মীদেরও রোজা পালনে বিঘ্ন ঘটবে। এ জন্যই আপত্তি জানিয়েছিলাম আমরা।”
মান্নানের অভিযোগ, রাজ্য সরকারই প্রথম থেকে রমজানের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়নি। তাঁর কথায়, “পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় চার দফার যে ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণা করেছিলেন, তাতে ১২ জুলাই, শুক্রবার ভোট ছিল। ওই দিন রমজান মাসের প্রথম জুম্মাবার। এখন রমজান মাসে ভোট না-করার আর্জি তুলে সরকার ভণ্ডামি করছে!”
পাশাপাশি সংখ্যালঘু নেতারা এ কথাও মানছেন যে, রমজান পালন করেই সাধারণ মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য, চাষের কাজ বা চাকরিবাকরি করেন। ভোট হওয়ার নজিরও ভূরি ভূরি। ইসলামি রাষ্ট্র কুয়েতে আগামী ২৭ জুলাই সংসদীয় ভোট হচ্ছে। ভারতেও ২০০৫-এ বিহারে, ২০০৬-এ তামিলনাড়ুর মাদুরাইয়ে, ২০০৮-এ দিল্লি, বিহার ও অন্ধ্রে এবং ২০০৯-এ হরিয়ানায় রমজান মাসেই ভোট হয়েছে। রমজান মাসে দৈনন্দিন কাজকর্ম বন্ধ থাকে না বা বন্ধ রাখার জন্য কোনও ধর্মীয় নির্দেশ যে নেই, সে কথা উল্লেখ করছেন সকলেই। তাই আদালত রায় দিয়ে দেওয়ার পরে মানুষকে এখন ভোট দিতেই উদ্বুদ্ধ করছেন তাঁরা। রমজানের সময় ভোট-প্রক্রিয়া চালু থাকায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভোটকর্মীদের যাতে সমস্যা না-হয়, তার ব্যবস্থা করার জন্য রাজ্য নির্বাচন কমিশনও চিন্তাভাবনা করছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত ভোট-কর্মীদের রমজান পালনে যাতে সমস্যা না হয়, সে দিকে নজর রাখা হবে বলে এ দিন কমিশন সূত্রে জানানো হয়েছে। বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, “রমজানের ব্যাপারে মুসলিম আবেগকে সম্মান জানিয়েই বলছি, সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগকে সামনে রেখে ভোট পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।” |