এক মাসে বিচারের অঙ্ক মিলছে না কিছুতেই
কামদুনি গ্রামে দাঁড়িয়ে দোষীদের বিচার ও সাজা এক মাসের মধ্যে মিটিয়ে ফেলা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার ১২ দিন পরে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করেছে রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশ। কিন্তু হাতে যেটুকু সময় রয়েছে, তাতে এক মাসের মধ্যে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে কামদুনি-কাণ্ডের বিচার শেষ করা কার্যত অসম্ভব বলে মনে করছেন অভিজ্ঞ আইনজীবী ও প্রাক্তন বিচারকদের একটা বড় অংশ।
সাধারণত এই ধরনের অপরাধের মামলায় চার্জশিট পেশের পরে ধাপে ধাপে আদালতে মামলার চার্জ গঠন, সাক্ষীদের সমন পাঠানো, সাক্ষ্যগ্রহণ, ময়নাতদন্ত ও ফরেন্সিক পরীক্ষার রিপোর্ট বিশ্লেষণ করা হয়। এ সব কাজ সারা হলে শুরু হয় অভিযুক্ত ও অভিযোগকারী পক্ষের সওয়াল-জবাব। রায়ের প্রশ্ন তার পরে। কামদুনিতে ধর্ষণ-খুনের ঘটনাটি ঘটেছে ৭ জুন। দিল্লির নির্ভয়া-কাণ্ড তার ছ’মাস আগের ঘটনা। দ্রুত বিচারের আশায় সেই মামলাটি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে তোলা হয়েছিল। কিন্তু এখনও তার নিষ্পত্তি হয়নি।
ওয়েস্ট বেঙ্গল রিটায়ার্ড জাজেস অ্যাসোসিয়েশন-এর সাধারণ সম্পাদক গোপালচন্দ্র সরকার এ ব্যাপারে বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী হয়তো রাজনৈতিক কারণে আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু যে প্রক্রিয়া মেনে বিচার চলে, তাতে এক মাসের মধ্যে রায় দান নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।” তাঁর সংযোজন, “ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে রায় ঘোষণার পরে সাধারণত উচ্চ আদালতে আবেদন করা হয়। এটা মাথায় রেখেই সব তথ্যপ্রমাণ খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে রায় দেওয়া হয়।”একই মত হাইকোর্টের আইনজীবী অতনু রায়চৌধুরীর। তাঁরও বক্তব্য, “রায় দেওয়া হয় বিচার ব্যবস্থার একটা প্রক্রিয়া মেনে। মুখ্যমন্ত্রী বা কোনও নাগরিকের পক্ষে তার দিনক্ষণ আগে থেকে বলে দেওয়া সম্ভব নয়।” এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারকও বলেন, “বাদী-বিবাদীর সওয়াল-জবাব কত দিন চলবে তা-ও আগে থেকে নির্দিষ্ট করে বলা যায় না।”
তবে আইনজীবী-বিচারক মহলের একাংশ অবশ্য দিন-তারিখের বিষয়টিকে ততটা গুরুত্ব দিতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী এক মাসের মধ্যে সাজার আশ্বাস দিলেও তা ঠিক দিন-তারিখ মেপে-গুনে বলেননি। তিনি বলতে চেয়েছিলেন, সরকার দ্রুত বিচার সম্পন্ন করতে তৎপর হবে।
বাস্তবে সেটা কতটা দ্রুত হতে পারে, ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের কাজের ঘণ্টাপিছু হিসেব কষে তার একটা আঁচও দিয়েছেন আইনজ্ঞরা। তাঁদের হিসেবটা এই রকম মাসে চারটি রবিবার বাদ দিলে ২৬ দিনের মধ্যে মামলার গোটা প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে রায় দিতে হবে।
ফাস্ট ট্র্যাক আদালতে সাধারণত দিনে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা কাজ হয়। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দেড়টা ও বেলা আড়াইটে থেকে বিকেল সাড়ে চারটে। অর্থাৎ, ২৬ দিনে সময় পাওয়া যায় মোট ১৪৩ ঘণ্টা। কামদুনি-কাণ্ডের চার্জশিটে এ পর্যন্ত ৫৪ জন সাক্ষীর নাম রয়েছে। সাক্ষীদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে করতেই কম-বেশি ৪৫ ঘণ্টা পার হওয়ার কথা। এ ছাড়া, ধৃতদের চার্জশিট বিলি থেকে শুরু করে সাক্ষীদের বয়ান, ফরেন্সিক রিপোর্ট-সহ যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ দু’দফায় বিশ্লেষণ করতে হবে। ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে বাস্তবে কখনওই এ সব কাজ শেষ করা যায় না। সাক্ষ্যগ্রহণের পরে হাতে যে ৮৯ ঘন্টা থাকবে, তাতে এত কাজ শেষ করা কিছুতেই সম্ভব নয়।
কিন্তু বিচারের এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যেই কিছু ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্তও রয়েছে। যেমন, গত ২৪ এপ্রিল মালদহের নাবালিকা ধর্ষণের ঘটনা। ঠিক ২৪ দিনের মাথায়, ১৭ মে অভিযুক্ত ৬০ বছরের এক প্রৌঢ়কে ১০ বছরের কারাবাসের সাজা দেন বিচারক। মুখ্যমন্ত্রী বিভিন্ন সভায় এই ঘটনাটির কথাই উদাহরণ হিসেবে বলছেন। তাঁর যুক্তি, মালদহে সম্ভব হলে কামদুনির ক্ষেত্রে কেন এক মাসের মধ্যে বিচার শেষ করা যাবে না?
আইনজীবীদের অনেকে কিন্তু এই যুক্তিতে ভরসা রাখতে পারছেন না। তাঁরা মনে করেন, মালদহের সঙ্গে কামদুনির ঘটনার তুলনা চলে না। মালদহে এক জনই অভিযুক্ত। ঘটনার পর দিনই তাকে গ্রেফতার করে তিন দিনের মধ্যে চার্জশিট পেশ করেছিল পুলিশ। ৮ দিনের মধ্যে আদালতে বিচার শুরু হয়ে যায়। অন্য দিকে, কামদুনির মামলায় অভিযুক্ত ন’জন। তাদের এক জন আবার ফেরার। দু’জনের বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রমাণ না পেয়ে পরে তদন্ত করে সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দেওয়ার আর্জি জানিয়েছে সিআইডি। এতে ফের আর এক দফা সাক্ষ্যগ্রহণ চলতে পারে।
সমস্যা আছে আরও। মালদহে ধর্ষিতার সাক্ষ্যের উপরে নির্ভর করে দ্রুত রায় দেওয়া গিয়েছে। কামদুনির তরুণী খুন হয়েছেন। নেই প্রত্যক্ষদর্শী। শুধু পারিপার্শিক তথ্যপ্রমাণের উপরে ভিত্তি করেই বিচারপ্রক্রিয়া চলবে। ফলে, এই মামলা মালদহের মতো দ্রুত শেষ করা বেশ কঠিন বলেই মনে করছেন অভিজ্ঞ আইনজীবী ও বিচারকদের অনেকে।

চার্জশিটে অসঙ্গতি, মেনে নিল সিআইডি
বারাসতের কামদুনিতে কলেজছাত্রীকে গণধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় সিআইডি যে-চার্জশিট আদালতে পেশ করেছে, তাতে কিছু ত্রুটি ও অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। অন্তত আইনজীবীদের একাংশের অভিমত তেমনই। তাঁদের বক্তব্য, চার্জশিটে যে ৫৪ জন সাক্ষীর কথা বলা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে তিন জন সাক্ষীর নাম রয়েছে দু’বার করে। মঙ্গলবার বারাসত আদালতেও আইনজীবীরা চার্জশিটের ভুলভ্রান্তি-অসঙ্গতির কথা তুলে ধরেন। কিছু অসঙ্গতির কথা মেনে নিয়েছে সিআইডি। তাড়াহুড়োয় চার্জশিটে একই সাক্ষীর নাম দু’বার লেখা হয়েছে বলে জানান এই মামলায় নিযুক্ত বিশেষ সরকারি আইনজীবী সন্দীপ ভট্টাচার্য। ডিআইজি (সিআইডি) বিনীত গোয়েল বলেন, “কাজ করতে গিয়ে ভুল হয়ে গিয়েছে। সংশোধন করা হবে।” চার্জশিটে দেখা গিয়েছে, সাক্ষীর তালিকায় মোট ৫৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪১ জনই গ্রামবাসী। বাকিরা সরকারি কর্মী, পুলিশ, চিকিৎসক। ৪১ জন গ্রামবাসীর মধ্যে দেখা যাচ্ছে, দীপঙ্কর ঘোষ, কৃষ্ণ ঘোষ ও লক্ষীকান্ত ঘোষের নাম দু’বার রয়েছে। সাক্ষী-তালিকার ১১ নম্বরে নাম রয়েছে কামদুনির বাসিন্দা দীপঙ্কর ঘোষের। আবার ৩৯ নম্বরেও আছে তাঁর নাম। ঠিকানা এবং বাবার নাম একই। ১২ নম্বরে নাম রয়েছে কৃষ্ণ ঘোষের। ফের তাঁর নাম আছে ৩৮ নম্বরে। বাবার নাম ও ঠিকানা একই। সেই রকমই ১৯ নম্বরে নাম রয়েছে লক্ষীকান্ত ঘোষের। আবার ৪০ নম্বরেও তাঁর নাম আছে। বিশেষ সরকারি আইনজীবী সন্দীপবাবু বলেন, “তাড়াহুড়োতেই এই ভুল হয়েছে। কয়েকটি নাম দু’বার করে সাক্ষীর তালিকায় আছে। সেগুলি সংশোধন করা হবে। সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট এখনও দেওয়া হয়নি। তাই সাক্ষীর সংখ্যা কমবেশি হতে পারে।” তবে তার জেরে মামলার কোনও ক্ষতি হবে না বলে তাঁর দাবি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.