বারাসতের কামদুনিতে কলেজছাত্রীকে গণধর্ষণ করে খুন করা হয় ৭ জুন। তার ২৫ দিন পরে, আজ, বুধবার বারাসত আদালতের ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে ওই মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। মামলাটির দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বারাসত আদালতের জেলা বিচারক মঙ্গলবার এই নির্দেশ দেন।
আদালতে ছিলেন মৃতার পরিবার এবং কামদুনির আন্দোলনকারীদের একাংশও। সিআইডি ওই মামলায় তিন অভিযুক্তের নাম চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়ায় বিক্ষোভ দেখান তাঁরা। চার্জশিটের কিছু ‘ত্রুটি ও অসঙ্গতি’ নিয়ে সরব হন আইনজীবীরা।
সকাল থেকেই বারাসত আদালতকে ঘিরে ছিল টানটান উত্তেজনা। পুলিশ ও র্যাফ দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয় গোটা আদালত চত্বর। কড়া নিরাপত্তায় দমদম সেন্ট্রাল জেল থেকে আদালতে আনা হয় অন্যতম অভিযুক্ত আনসার আলি-সহ ধৃত আট জনকে। বেলা ১২টার মধ্যেই ম্যাটাডর ভ্যানে চড়ে পৌঁছে যান কামদুনিবাসীরা। ‘প্রতিশ্রুতিমতো এক মাসের মধ্যেই দোষীদের ফাঁসি চাই’ লেখা পোস্টার, প্ল্যাকার্ড নিয়ে মৌসুমী কয়াল-সহ গ্রামের মহিলারা আদালতের বাইরে বসে পড়েন। তাঁদের দেখে ভিড় জমান বারাসতের মানুষও। নিহত ছাত্রীর ভাইকে জড়িয়ে ধরে কেউ কেউ বলেন, “আমরাও তোমাদের পাশে আছি।” |
বারাসত আদালতে এ দিন বিচার প্রক্রিয়া চলে তিন পর্বে। এত দিন মামলাটি ছিল মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে। সেখান থেকে এ দিন সেটি জেলা জজের আদালতে পাঠানো হয়। সেখানে হাজির ছিলেন সিআইডি-র তদন্তকারী অফিসারেরা। ধৃতদের হাজির করানো হয় আদালতে। তাদের চার্জশিটের প্রতিলিপি দেওয়া হয়। বিকেলে জেলা বিচারক নির্মলকুমার ঘোষাল জানান, বুধবার তৃতীয় ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের বিচারক অর্পণ চট্টোপাধ্যায়ের এজলাসে বিচার শুরু হবে। এই মামলায় সরকার পক্ষের বিশেষ কৌঁসুলি সন্দীপ ভট্টাচার্য ও বিপ্লব রায় বলেন, “বুধবার হাজিরার পরে ক্রমান্বয়ে মামলার চার্জ গঠন ও সাক্ষ্যগ্রহণের প্রক্রিয়া চলবে।” মামলায় ৫৪ জনকে সাক্ষী করেছে সিআইডি।
সিআইডি-র পেশ করা চার্জশিটের ‘ত্রুটি ও অসঙ্গতি’র দিকে জেলা বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বারাসত আদালত ও কলকাতা হাইকোর্টের বেশ কিছু আইনজীবী। বারাসত আদালতের আইনজীবী রঞ্জিত সাহা ও হাইকোর্টের আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ধৃত আট জনের মধ্যে ছ’জনের নামে চার্জশিট দেওয়ায় বাকি দু’জনকে আইনত আটকে রাখা যায় না। কামদুনি কাণ্ডের মতো ঘটনায় এই ধরনের ত্রুটিপূর্ণ চার্জশিটের জন্য আইনি জটিলতা তৈরি হবে। |
পরে আদালতের বাইরে জয়ন্তবাবু বলেন, “সিআইডি তাড়াহুড়ো করে চার্জশিট দিয়েছে।” তাঁর অভিযোগ, চার্জশিটে সইফুল আলিকে মূল অভিযুক্ত দেখানো হয়েছে। বাকিদের বিরুদ্ধে শুধু তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগ আনা হয়েছে। এর ফলে তারা আবেদন করলে সহজেই জামিন পেয়ে যাবে বলে তাঁর আশঙ্কা। বারাসতে দুষ্কৃতীদের হাত থেকে দিদিকে বাঁচাতে গিয়ে খুন হয়েছিল মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী রাজীব দাস। সেই মামলার মতো কামদুনি কাণ্ডেও আসামিদের তরফে মামলা না-লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বারাসত আদালতের আইনজীবীরা। সরকারি তরফে রুইদাস পাল নামে এক আইনজীবীকে নিয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু রুইদাসবাবুও এ দিন জানিয়ে দেন, আসামিদের পক্ষ নিয়ে তিনি এই মামলা লড়বেন না।
বিকেলে আদালত থেকে দমদম জেলে নিয়ে যাওয়ার সময় প্রিজন ভ্যানে উঠেই কেঁদে ফেলে অভিযুক্ত আনসার। তার ভাই আরশাদ আলি হাত তুলে তাকে আশ্বস্ত করেন, “চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই কিন্তু কিছু দেখিসনি।”
আদালতে কাজ শেষ হওয়ার পরে নিহত ছাত্রীর ভাই বলেন, “যাদের নামে এফআইআর হয়েছে, আমরা চাই, তাদের কেউ যেন ছাড়া না-পায়। যত দ্রুত সম্ভব দোষীদের ফাঁসি না-হলে আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।”
কামদুনির বাসিন্দারা আন্দোলনে অনড় থাকার কথা জানালেও তাঁদের রাষ্ট্রপতির দরবারে নিয়ে যাওয়ার জন্য তদ্বির করেও রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী রীতিমতো হতাশ। সেখানকার মানুষই যেতে চাইছেন না বলে এ দিন জানান তিনি। কামদুনির ঘটনার পরে অধীরবাবু ওই গ্রামে গিয়েছিলেন। তখন কামদুনির মানুষই তাঁকে জানিয়েছিলেন, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে দোষীদের কঠোর শাস্তির দাবি জানাতে চান তাঁরা। এ দিন বনগাঁ স্টেশন পরিদর্শনে এসে অধীরবাবু বলেন, “ওঁরা এখন ‘আজ না কাল’ করছেন। আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। রোজ তো আর সকাল-বিকেল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার সময় পাওয়া যায় না! ওঁরাই যাবেন বলেছিলেন। এখন কেন যেতে চাইছেন না, জানি না। ফলে আমার আর কিছু করার নেই।”
|