আগের রাতে জুয়া খেলে তিন হাজার টাকা জিতেছিল ইমানুল মোল্লা। সেই টাকাতেই আনা হয়েছিল মদ-মাংস। সকাল থেকে ভরা বৃষ্টির মধ্যে রাস্তার ধারে বাঁশের মাচায় বসে ফুর্তি সেরে ৭ জুন দুপুরের দিকে আনসার আলির পাঁচিল ঘেরা ডেরায় ঢুকেছিল ভুট্টো মোল্লা-সইফুল মোল্লারা। তখনই তারা দেখতে পায়, কামদুনি গ্রামের এক কলেজ ছাত্রী একা ছাতা মাথায় বাড়ি ফিরছে। ওই ছাত্রীকে গণধর্ষণ ও খুনের মামলায় ফরেন্সিক রিপোর্ট ছাড়াই শনিবার যে চার্জশিট পেশ করেছে সিআইডি, তাতেই এ কথা বলা হয়েছে।
আর এতে কিছুটা হলেও সরকারের মুখরক্ষা হল বলে ধারণা পুলিশকর্তাদের একাংশের। কারণ, কামদুনির ঘটনার ১০ দিন পরে প্রথমে মৃতার বাড়িতে গিয়ে, পরে বিভিন্ন জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ১৫ দিনের মধ্যে চার্জশিট দেবে সিআইডি। কিন্তু সেই সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও ফরেন্সিক রিপোর্ট হাতে না পাওয়ায় মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া আশ্বাস বাস্তবায়িত করতে পারেনি তারা। শেষে কার্যত প্রতিশ্রুতি রাখতেই ফরেন্সিক রিপোর্টের অপেক্ষায় না থেকে এ দিন, ছয় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বারাসত আদালতের ভারপ্রাপ্ত মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট ঈশাণী চক্রবর্তী (বন্দ্যোপাধ্যায়)-র এজলাসে চার্জশিট জমা দেয় সিআইডি। কেন ফরেন্সিক রিপোর্ট ছাড়াই কামদুনি-কাণ্ডে চার্জশিট জমা পড়ল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। তাঁর বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ১৫ দিনে চার্জশিট পেশ হবে। কিন্তু তা হল ২২ দিন বাদে। তা-ও ফরেন্সিক রিপোর্ট ছাড়াই দুর্বল চার্জশিট দেওয়া হল। কেন দেওয়া হল?”
যে ছ’জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ হয়েছে, তাদের নাম আনসার আলি, সইফুল মোল্লা, ইমানুল মোল্লা, ভুট্টো মোল্লা, গোপাল নস্কর ও ভোলানাথ নস্কর। এফআইআরে নাম থাকা এক জনকে এখনও খুঁজে পায়নি পুলিশ। তার নাম মহম্মদ রফিক। সিআইডি-র দাবি, কামদুনি ও লাগোয়া এলাকায় খোঁজাখুজি করেও ওই নামে কোনও যুবকের সন্ধান মেলেনি। তাই রফিকের নাম চার্জশিটে রাখা হয়নি। একই সঙ্গে বাদ দেওয়া হয়েছে এফআইআরে নাম থাকা অন্য দুই যুবক আমিন মোল্লা ও নুর আলির নামও। যদিও এখনও তারা সিআইডির হেফাজতেই আছেন। সিআইডির বক্তব্য, উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ না মেলায় চার্জশিটে তাদের নাম দেওয়া হয়নি।
চার্জশিটে বলা হয়েছে, সইফুলই ওই কলেজ ছাত্রীকে মুখ চেপে ধরে। তার পরে টেনেহিঁচড়ে আনসারের পাঁচিল ঘেরা ডেরায় ঢুকিয়ে নেয়। উপযুর্পরি ধর্ষণের ফলে ছাত্রীটি আর্তচিৎকার করলে, সইফুলই তাঁর মুখ চেপে ধরে। তাতেই শ্বাসরোধ হয়ে ওই ছাত্রীর মৃত্যু হয় বলে চার্জশিটে জানিয়েছে সিআইডি। তদন্তকারী সংস্থার বক্তব্য, সইফুলই মৃতদেহটিকে টেনে পাঁচিলের কাছে নিয়ে যায়। হাত লাগায় অন্যরাও। এর পরে দেহটিকে পাঁচিলের বাইরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ডেরা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে সকলে। পুলিশ জানিয়েছে, সন্ধের দিকে মেয়ে ফিরছে না দেখে বাড়ির লোক খুঁজতে বের হন। সেই সময় টর্চ দিয়ে তাঁদের সাহায্যও করে আনসার। সিআইডি বলেছে, অভিযুক্তদের চিনে ফেলাতেই খুন হতে হয়েছে ওই ছাত্রীকে।
সিআইডি সূত্রের খবর, কামদুনি-কাণ্ডে ১৪০ পাতার যে চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছে, তাতে ৫৪ জনের সাক্ষ্য আছে। তাঁরা সকলেই স্থানীয় বাসিন্দা। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ ও সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগ আনা হয়েছে চার্জশিটে। সিআইডি-র এডিজি শিবাজী ঘোষ এ দিন বলেন, “কামদুনিতে কলেজ ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় কোনও প্রত্যক্ষদর্শী নেই। অভিযুক্ত দু’জনের গোপন জবানবন্দিই এই মামলায় সব চেয়ে বড় প্রমাণ।”
কারা দিয়েছিল সেই জবানবন্দি? পুলিশ জানিয়েছে, সইফুল মোল্লা ও ভোলানাথ নস্কর জেরা চলাকালীনই আদালতে জবানবন্দি দেয়। গত ৭ জুন কামদুনিতে কী ভাবে ওই ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল, তা-ও তদন্তকারীদের সঙ্গে ঘটনাস্থলে গিয়ে অভিনয় করে দেখিয়েছে সইফুল।
কিন্তু ফরেন্সিক রিপোর্ট ছাড়াই তড়িঘড়ি চার্জশিট পেশ করা হল কেন? সরাসরি জবাব এড়িয়ে শিবাজীবাবুর বক্তব্য, “এ ভাবে চার্জশিট পেশ করায় কোনও অসুবিধা নেই। ফরেন্সিক রিপোর্ট পেলে সেটি মূল চার্জশিটের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে।” সিআইডি কামদুনি-কাণ্ডের তদন্তভার নেয় ৯ জুন। তার আগেই অবশ্য চার অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে উত্তর ২৪ পরগনা পুলিশ। পরে সিআইডি আরও চার জনকে ধরে। তদন্ত দ্রুত শেষ করতে সিআইডির স্পেশাল সুপার রাজেশ যাদবের নেতৃত্বে একটি বিশেষ দল তৈরি করে দেন এডিজি। |