বহরমপুর শহরের বাচিক শিল্পচর্চার মুক্ত দিগন্ত নামে একটি সংস্থা কামদুনি কাণ্ডের ৮ দিন পরে একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছিলেন। কবিতা-গান-কথায় সেখানে প্রতিবাদ জানানো হয়। ওই সভায় হাজির ছিলেন সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে যুক্ত শহরের অনেক মানুষ। ভিড় উপচে পড়ে গোরাবাজার জজ কোর্ট মোড়ে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কিন্তু এখনও পথে নামতে পারলেন না বহরমপুরের সুশীল সমাজ!
সুশীল সমাজের প্রতি তীব্র ব্যঙ্গ করে বহরমপুরে পোস্টারও পড়ে। সেই পোস্টার ঘিরে তুমুল বিতর্ক আছড়ে পড়ে ফেসবুকের পাতায়। কেউ লিখেছেন, ‘বহরমপুরের সেই দম অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। যারা ছিলেন, তারা আর নেই। এখন সবাই হয় মৃত অথবা অর্ধমৃত। সত্যিই পথে নামার লোকগুলো কই? দুঃখ হয় শহরের জন্য। আমার প্রিয় শহর আজ কুঁড়ে, ভীতু শহর।’ কেউ লেখেন, ‘রাজ্য জুড়ে বেড়ে চলা নারী নির্যাতনের ঘটনায় ঋত্বিক ঘটক, মণীশ ঘটক, পম্পু মজুমদারের শহরকে চুপ দেখে, পথে না নেমে নেহাত আমোদপ্রমোদে ব্যস্ত দেখে, অবাক হয়েছি।’
এর পরেও কেটে গিয়েছে অনেক দিন! কামদুনির পরে ঘটে গিয়েছে গাইঘাটা-রানিতলা-সালার-খোরজুনার মতো ঘটনা। সমাজকর্মী সীমা সরকারের আক্ষেপ, “প্রতিবাদে এখনও পথে নামতে পারলাম না, এটা আমার কাছে বড় ব্যথার। খোরজুনার ঘটনাও আমাদের চেতনার দরজায় এসে ধাক্কা দিতে পারল না! আমরা কি তাহলে ঘুমিয়েই আছি, জেগে উঠব না!”
তবে গত ২৮ জুন রাজ্যে বেড়ে চলা নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে পথে নামতে উদ্যোগী হয় বহরমপুরের সুশীল সমাজ। কিন্তু তুমুল বৃষ্টি ওই আয়োজনে জল ঢেলে দেয়। আগামী শনিবার সুশীল সমাজ পথে নামবেন বলে ঠিক হয়েছে। সাংস্কৃতিক কর্মী অনুপম ভট্টাচার্য বলেন, “কলকাতার বুদ্ধিজীবী মহল যত দ্রুত পথে নামার জন্য সংগঠিত হতে পারেন, আমরা তা পারি না। কারণ আমাদের শহরে কোনও শঙ্খ ঘোষ নেই। শঙ্খ ঘোষের কথা বললাম এই কারণে যে, তাঁর মতো সর্বজনগ্রাহ্য ব্যক্তিত্বের অভাব রয়েছে। আমাদের শহরের যে দু-এক জন আছেন, তাঁরা আবার নিজেদের গুটিয়ে রেখেছেন। প্রতিবাদের ভাষাও পথ হারিয়ে ফেলছে।”
গত ৮ জুন কামদুনি কাণ্ড ঘটে। এর পরে ১৬ জুন বহরমপুরের গোরাবাজারে কবিতায়-গানে-কথায় প্রতিবাদ সভা, মোমবাতি মিছিল বের করে অন্য এক আবৃত্তি সংস্থা। তার পরেই দীর্ঘ নীরবতা! ১৯ জুন মুখ্যমন্ত্রী কামদুনি গ্রামে যাওয়ার পরে যখন গ্রামের সাধারণ মহিলারা পথে নেমে ঘটনার প্রতিবাদে নামেন। তার দু’দিন পরে শঙ্খ ঘোষের নেতৃত্বে কলকাতার বুদ্ধিজীবী মহল পথে নামেন। বাচিক শিল্পী অভিজিত্ সরকার বলেন, “কামদুনির আগেও নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরের মহিলারা যখন লাঠি-ঝাঁটা হাতে প্রতিবাদে পথে নামেন, তখনই আড়মোড় ভেঙে বুদ্ধিজীবী মহলকে দেখেছি প্রতিবাদের মিছিলে হাঁটতে। তবে বহরমপুরের সুশীল সমাজ সঙ্ঘবদ্ধ নন। তাই পথে নামতে দেরি।” তবে ৭০ এর দশকের শেষের দিকে এই নাগরিক সমাজই সার্কাস ময়দানে অশ্লীল নাচের বিরোধিতায় মিছিল করে। তাঁদের বিরোধিতায় বিমল কালচারাল হলে বন্ধ হয়ে যায় নাচের অনুষ্ঠান। বহরমপুরের সিনেমা হলগুলিতে অশ্লীল সিনেমা চালানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। সম্প্রতি শাহবাগ আন্দোলনের স্বপক্ষেও মিছিল করেন বহরমপুরের সাংস্কৃতিক কর্মীরা। গোধরা কাণ্ডের পরে বহরমপুর-বেলডাঙায় কমিটি গঠন করে বুদ্ধিজীবীরা আন্দোলনে নামেন। ওই ঘটনায় ঋত্বিক সদন এবং হরিমতী গার্লস হাইস্কুলে সেমিনার-কনভেনশনের আয়োজনও করতে হয়। সাংস্কৃতিক কর্মী সন্দীপন মজুমদার বলেন, “সাংস্কৃতিক কর্মী বা সুশীল সমাজের প্রভাব আমাদের নাগরিক জীবনে কলকাতার তুলনায় কম। তার বড় কারণসাংস্কৃতিক জগতের নিয়ন্ত্রক কলকাতা। মফস্সলের কবি-সাহিত্যিক সামাজিক কর্তৃত্ব বা প্রভাবের দিক থেকে ততটা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেন না।” ছান্দিকের শক্তিনাথ ভট্টাচার্য জানান, সাধারণ নাগরিকের উপরে মফস্সলের সুশীল সমাজের প্রভাবও কম। ফলে তাঁদের একটা মিছিল বা প্রতিবাদ সভা কখনও গোটা নাগরিক সমাজকে আন্দোলিত করে না। একই কথা বলেন জিয়াগঞ্জ শ্রীপত্ সিংহ কলেজের অধ্যক্ষ শামসুজ্জামান আহমেদ। তিনি বলেন, “কলকাতার সুশীল সমাজ দ্রুত সঙ্ঘবদ্ধ হতে পারে। মফস্সলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকার জন্য অনেক সময়ে তা সম্ভব হয় না।” |